Wednesday, March 7, 2018

বোহেমিয়ান ডায়েরী ( শেষ পর্ব) / মে-২০১৬

সোহাগী প্রাগের টানে
(সানন্দা বিশেষ ভ্রমণ সংখ্যায় প্রকাশিত) 



 ভিয়েনা থেকে ব্রুনো হয়ে প্রাগে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল।  হোটেলে মালপত্র রেখে ডিনার খেয়েই শুরু হল আমাদের বোহেমিয়ান ট্রিপের অন্যতম সফর "নাইট ওয়াক ইন দ্যা সিটি অফ প্রাগ"।  মনে মনে বলি কোথায় ? এ যে  দেখি পড়ন্ত বিকেল গো! সাত তাড়াতাড়ি ডিনার খেয়েই ছুট?  আকাশে তখনো কটকটে রোদ। বাতাসে যেন বসন্তের রেশ। প্রথমে বাসে চড়ে নামা হল পাহাড়ের মাথায়  স্ট্রাহভ মনাষ্ট্রি দেখতে। মনাষ্ট্রিতে আবার বিয়ার ব্রুয়ারি! ভাবা যায়?  সেখান থেকে দুর্গ শহর প্রাগের  অতি সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যায়।এই ভিউপয়েন্টে গিয়ে সেন্ট নরবার্টিনের বেত্তান্ত শোনা হল স্থানীয় গাইডের মুখে।  
 স্ট্রাহভ মনাস্ট্রিতে সেন্ট নর্বার্টিনের রেলিক্স রাখা রয়েছে। আছে প্রকান্ড লাইব্রেরীতে বিশাল ব‌ইয়ের সম্ভার আর ব্যাসিলিকায়  ফ্রেসকো এবং  ভার্জিন  মেরীর মোটিফ থেকে সবকিছুই সযত্নে সংরক্ষিত। রাখা রয়েছে প্রকান্ড এক অর্গ্যান যা বাজিয়ে মোত্জার্ট বলেছিলেন এমন বড় ও সুন্দর অর্গ্যান তিনি আর কোনোদিনো বাজাননি। 
পশ্চিম ইউরোপ যেমন জার্মাণিক, পূর্ব ইউরোপের প্রাগ শহরে প্রধানতঃ স্লাভিক ট্রাইবদের বাস।  চেক ভাষায় প্রাগের নাম প্রাহা। যার অর্থ হল "ford" বা "rapid" । আক্ষরিক অর্থে ভ্লাতাভা নদীর ব্রিজের ওপর দিয়ে পেরোতে হয় এই অঞ্চল যেখানে নদীর গভীরতা অত্যন্ত কম। মানুষ ও ঘোড়াও সেই তিরতির করে বয়ে চলা অগভীর নদীর মধ্যে দিয়ে অনায়াসে এককালে পেরিয়ে চলত । এখন সেখানে ছোট্ট ব্রিজ হয়েছে। তবে প্রাহা নামটির উত্সমূল জেনে বেশ লাগে।  
এবার পিটার শোনায় চেক কিংবদন্তীর কড়চা। বুদ্ধিমতী ও জ্ঞানী স্লেভিক রাজকন্যা লিবিউসে অসাধারণ ভবিষ্যদ্বাণী করতেন । পাহাড়ের মাথায় তিনি আর তার স্বামী রাজপুত্র প্রেমিস্ল শান্তিপূর্ণভাবে রাজ্য শাসন করত। একদিন পাহাড়ের মাথায় উঠে, ভ্লাতাভা নদীর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে তিনি বললেন, অদূর ভবিষ্যতে এই শহর হয়ে উঠবে পূর্ব ইউরোপের শ্রেষ্ঠ শহর। খ্যাতির শিখরে পৌঁছবে তার শিল্প-কলা-কৃষ্টির উত্কর্ষতায়। একজন মানুষ তাঁর দৃষ্টিপথেই একটি বিশাল দুর্গ বানিয়ে চলেছিল। রাণী বললেন আর ঐখানেই  সেই চরম শহরায়ণের সব লক্ষণ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এবং ফলেও গেল তাঁর কথা।  তাই তো এই শহর চেক রিপাব্লিকের রাজধানী শহর যার নাম প্রাহা। 

আবারো পায়ে হেঁটে প্রাগের ওল্ড টাউন স্কোয়ারে ঘোরা। এই প্রাগ আমাদের নিয়ে গেল ফিজিক্স ব‌ইয়ের পাতায়। জোহান কেপলার ও টাইকো ব্রাহের জ্যোতির্বিদ্যার অনেক কিছু আবিষ্কার ঘটেছিল এখানে। পথের ধারে দুজনার স্ট্যচুটি প্রমাণস্বরূপ আজো সেখানে।  দুই দিকপাল জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহে আর জোহানেস কেপলার আসেন প্রাগে। টাইকো ব্রাহে ছিলেন উত্কৃষ্ট পর্যবেক্ষক আর কেপলার ছিলেন গণিতজ্ঞ। এই প্রাগেই টাইকো ব্রাহে কেপলারকে তাঁর সহকর্মী করলেন।  আকাশে হঠাত টাইকো দেখতে পেলেন অদ্ভূত সুপারনোভা। কেপলার তা থেকে অঙ্ক কষে সূত্র তৈরী করলেন। হয়ত একে অপরের পরিপূরক ছিলেন কিম্বা তাঁদের মধ্যে ছিল চরম ইগোর দ্বন্দ। কিন্তু সেই মূহুর্তে আমার কাছে এঁদের গল্প শোনা মানেই আমার ফিজিক্স ব‌ইয়ের  সেই ছবিদুটিতে মনে মনে প্রণাম জানানো আর প্রাগের রাস্তায় এঁদের স্ট্যাচু দেখে আকুলিবিকুলি প্রাণ।
এরপর সেন্ট নিকোলাস চার্চ।  কোবলস্টোনের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় এদের সবকিছু সংরক্ষণই এত সুন্দর? এরা দুটি বিশ্বযুদ্ধের পরেও তো এরা নিজেদের অনেক ভেঙেচুরে আবারো গড়ে তুলেছে। আর সর্বোপরি রেখেছে কি চমত্কার!

রাস্তা পেরোই  ট্রামলাইনের ওপর দিয়েই। কি অপূর্ব এই স্ট্রীটকারের মায়াবী নেটওয়ার্ক।  সারা শহরের অলিগলি রাজপথ থেকে ক্রিসক্রস ভাবে রঙীন সুন্দর সুন্দর ট্রাম চলে যাচ্ছে অনবরত। আর এরা কত সুন্দরভাবে এই যানটিকে ব্যাবহার করে সেটাই দেখবার।  প্রাগের ট্রামের নেটওয়ার্ক চেক রিপাবলিকের মধ্যে সর্বোত্তম এবং সবচেয়ে বৃহত। 
রাস্তায় হাঁটি অবলীলায়। জেব্রাক্রসিংয়ে পা দিয়ে, ট্র্যাফিক লাইট মেনেই। আর চোখে পড়ে অসাধারণ রেনেসাঁ স্থাপত্য।  মনে মনে ভাবি সমগ্র ইউরোপটাই কি এত সুন্দর! কাকে দেখি আর কার থেকে মুখ ঘোরাই?  এবারে গাইডের ধারাভাষ্যে কান পাতি আর শুনি প্রাগের লেসার( Lesser) টাউনের কথায়।   এই লেসার টাউন স্কোয়ারের  ল্যান্ডমার্ক হল রাজকীয় সেন্ট নিকোলাস চার্চ। ওল্ড টাউন স্কোয়ারের কেন্দ্রবিন্দুতে এই চার্চ ।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চেক আর্মির ঘাঁটি ছিল এই নিকোলাস চার্চ। চার্চটির সংরক্ষণের জন্য   এই সেনাবাহিনীর নিরলস পরিশ্রম আর সেই সাথে নামীদামী স্থপতিদের শিল্পকলায় ভরে উঠেছিল চার্চের অন্দর ও বাইরের মহল।  সেন্ট নিকোলাস চার্চটি একাধারে গীর্জা অন্যধারে ক্লাসিকাল কনসার্টের অন্যতম প্রেক্ষাগৃহ বা মঞ্চ।   
বাইরে  থিকথিক করছে রেস্তোঁরা, পাব, দোকানপাট, ব্যুটিক আর প্রাগের বিখ্যাত মানুষ, ধনী লোকজনের ব্যারক স্টাইলের ঘরবাড়ি। ইন্টারন্যাশানাল এমব্যাসিগুলিও এখানে। এই  ব্যারক স্টাইল হল অত্যন্ত সুন্দর স্থাপত্যে নির্মিত বাড়ি। জানলার নীচে খোদাই করা মানুষের মুখ, বাড়ির ছাদের প্যারাপেটে পরী কিম্বা প্রবেশ পথে জীবজন্তুর অসামান্য আর্কিটেকচার।  পুরণো শহরের অনুপাতে অনেকটাই ছোট বলে এর নাম লেসার টাউন।  
এবার একফালি অন্ধকার সুড়ঙ্গ দিয়ে আবারো বড় রাস্তায় গিয়ে পড়ি। পিটার  মোবাইলে ডেকে নিলেন সেদিনের জন্য বুক করা আমাদের প্রাইভেট ট্রামের একটি কামরাকে। ম্যাজিকের মত ট্রাম এসে দাঁড়ালো সামনে। উঠে পড়লাম টুক করে। কি সুন্দর অনুভূতি। স্বপ্নের মত সেই সন্ধ্যেয় প্রাগের  ট্রামে চড়া আর একটা গলির মুখে অবতরণ করে পাথরের রাস্তা দিয়ে এক বিয়ার ব্রুয়ারীর মধ্যে প্রবেশ করা। বোহেমিয়ান বিয়ার নাকি বিখ্যাত। তেমনি এক বিয়ার পাবে সেদিনের সান্ধ্য আড্ডা জমে গেল। বিশাল সুদৃশ্য কাটগ্লাসের মাগে বিয়ার হাজির হল সাথে টুকটাক । এককোণায় প্রৌঢ় বাজিয়ে চলেন একর্ডিয়ানে চেনাঅচেনা গানের সুর। আলো আঁধারিতে মায়াময় পরিবেশ।  ঘন্টাখানেক পর পাব থেকে বেরিয়ে পড়ি সকলে মিলে। আবার পায়ে হেঁটে আলোকমালায় সজ্জিত রোমান্টিক প্রাগের রাজপথে উঁকি দি। পথ হয় গাইডের ধারাভাষ্যে গল্পমুখর।চোখ রাখি সেই বিখ্যাত জার্মাণ ইউনিভাসিটি অফ প্রাগে যেখানে এলবার্ট আইনস্টাইন থিওরিটিকাল ফিজিক্সে অধ্যাপনা করেছিলেন।  পেরুতেই চোখ রাখতে হয় চারজন মিউজিশিয়ানের অনবদ্য স্ট্যাচুতে। প্রাগের বিখ্যাত স্থাপত্যগুলির একটি। চারজনের হাতে চারটি বাদ্যযন্ত্র। স্থপতির কল্পনায় বিশ্বের বৃহত্তম চারটি নদী আমাজন, মিসিসিপি, গঙ্গা এবং দানিয়ুব এর এক একরকম কলতান নাকি এই চার বাদ্যশিল্পী চোখ বন্ধ করে বাজিয়ে চলেছে । চার নৃত্যরত শিল্পীর চোখ বাঁধা। তাদের হাতে ম্যান্ডোলিন, ভায়োলিন, বাঁশী ও ট্রামপেট।  
 এবার গিয়ে উঠি ভ্লাতাভা নদীর ওপরে চার্লস ব্রিজের ওপরে। বিশাল চওড়া হাঁটার পথ। ব্রিজের ডাইনে বাঁয়ে সব পিলারের মাথায় দন্ডায়মান  সারেসারে  স্থাপত্য। রাজ পুরোহিত সেন্ট জন নেপোমুকের স্ট্যচুটির সামনে গিয়ে থামি।স্ট্যাচুর মাথার চারিপাশ দিয়ে একটি ধাতব রিংয়ে পাঁচটি সোনালী স্টার খচিত।  ভ্লাতাভা নদীর ব্রিজের ঠিক ঐ স্থানটি থেকে তাঁকে নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন রাজা কারণ পুরোহিতের কাছে রাজা তাঁর  রাণীর স্বীকারোক্তির কথা জানতে চেয়েছিলেন  এবং পুরোহিত তা জানাতে চান নি।  অতি জাগ্রত এই স্ট্যাচুটি ছুঁলে নাকি মনোস্কামনা পূর্ণ হয়। স্থানীয় মানুষ ব্রিজের গায়ে ছোট ছোট তালা লাগিয়ে দেয়, অনেকটা আমাদের ঠাকুরের থানে গিয়ে লাল সূতো বাঁধার মত। নদীর ওপরে পুরণো ব্রিজ, নতুন ব্রিজ একই সময়ে মানে ঐ রাতেই ক্রস করছি, বেশ লাগল ভেবে। 
আকাশে তখন কৃষ্ণা চতুর্থীর চাঁদ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে পায়ে হেঁটে রূপসী প্রাগের পথ চলার শেষে এবার ভৌতিক অনুভূতি। ছমছম করে ওঠে গা। চোখের পলক পড়েনা গাইডের মুখ গল্প শুনে।  মাথাকাটা এক সাধুর গল্প বলে চলে সে। তার অতৃপ্ত আত্মা নাকি এখনো ঘুরে বেড়ায় মনাষ্ট্রির সিঁড়িতে। সেই সাধু অভাবের তাড়নায় কি যেন বেচার চেষ্টায় ছিলেন তাই তার মাথা কেটে দেন অন্য সাধুরা।  হেডলেস মঙ্কের গল্প শুনেই মনে হয় কখন বাড়ি থুড়ি হোটেল যাব। 
পৌঁছে যাই সেন্ট অ্যাগনেস মনাষ্ট্রির মধ্যে।  বেরিয়েই  পাউডার গেট ( চেক ভাষায় যার নাম Prašná brána)  প্রাগের এক গথিক টাওয়ার সহ প্রবেশদ্বার যেন আমাদের গেট ওয়ে অফ ইন্ডিয়া বা ইন্ডিয়া গেটের মত। এই প্রবেশদ্বার প্রাগের ওল্ডটাউনকে নিউটাউন থেকে পৃথক করেছে।  সেখানে দাঁড়িয়ে গল্প শুনি সেন্ট এগনেস নামে এক রাজকন্যার যে আটবছর বয়সে বাগদত্তা ছিল  দশবছরের এক রাজপুত্রের সঙ্গে।  আর তারপর তার সংসারে বীতরাগ জন্মানো আর কৃচ্ছ্রসাধনে ব্রতী হয়ে ভক্তিমার্গে বিচরণের গল্প শুনতে শুনতে  ওল্ড টাউন স্কোয়ারের  Wensessler স্কোয়ারে পা বাড়ানো। বোহেমিয়ার প্যাট্রন সেন্ট Wenceslas এর নামে এই স্কোয়ারের নাম।  এই ঐতিহাসিক স্থানটি হল প্রাগের হেরিটেজ সাইট।  মধ্যযুগে এখানে ঘোড়ার বাজার ছিল। এবারে বোহেমিয়ান রাজা চতুর্থ চার্লসের নিউ টাউন স্কোয়ার বানানোর গল্প শুনে পথ চলি। আলোয় ঝলমলে তখন প্রাগের নিউটাউন।  রাতের আলোয় ন্যাশানাল মিউজিয়াম, Wenceslas মনুমেন্ট  এক অদ্ভূত রোমান্টিক স্থান। 

ওল্ড টাউন স্কোয়ার থেকে প্রাগ কাসল যাবার পথেই পড়ল "নাইটস অফ দ্যা ক্রস স্কোয়ার"... প্রাগের বিখ্যাত রাজপথ,  টুরিষ্টদের অন্যতম গন্তব্য। ডিজিটাল ক্লিকে, সেলফি স্টিকে রাজকীয় রাতপরী প্রাগের ছবি তখন ক্যামেরায় ধরে নেবার পালা। সেই স্কোয়ার অন্যদিকে চার্লসব্রিজকেও ছুঁয়েছে।    স্কোয়ারের মধ্যিখানে রাজা চতুর্থ চার্লসের বিশাল সেমি-গথিক স্ট্যাচু । শহরের আলোয় ঝলমলে প্রাগ তখন যেন যৌবনউদ্ভিন্না। চালর্স ইউনিভার্সিটির ৫০০ বছর পূর্তিতে রাজার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এই স্মারক নির্মিত হয়েছিল।  
স্কোয়ারের আশপাশের গথিক স্টাইল অট্টালিকার প্যারাপেটে দাঁড়িয়ে সারে সারে ভাস্কর্য। কি অপূর্ব তারা ! পেছন থেকে আলো এসে পড়েছে সর্বাঙ্গে।  

আবারো মোবাইলে ডেকে নেওয়া হয় ট্রামকে। সেরাতের মত প্রাগ শহরকে বিদায় জানিয়ে হোটেলে গিয়ে ঘুমে ঢলে পড়ি  আর আমার স্বপ্নে এসে তখন ধরা দেয় সেই প্রাগসুন্দরী। মনে হয় স্বচ্ছন্দ্যে হাঁটতে পারি আরো আরো পথ তার সঙ্গে ।   

কখন যাবেনঃ মে থেকে আগষ্ট 
কিভাবে যাবেনঃ চেক রিপাবলিকের ক্যাপিটাল প্রাগে যেতে যেকোনো ইউরোপিয়ান শহর থেকেই ফ্লাইট নেওয়া যায়। অথবা ট্যুরগ্রুপের সাথে গেলে তারা বাস প্রোভাইড করে।  
কোথায় থাকবেনঃ  ট্যুরিষ্টপ্লেস প্রাগে সবধরণের হোটেলের রমরমা। ট্যুর কোম্পানির সাথে যাওয়াই ভাল।
আমরা ট্রাফালগার ট্যুর কোম্পানির সঙ্গে ঘুরেছিলাম। প্রত্যেক হোটেলেই বেড এন্ড ব্রেকফাস্ট ইন্ক্লুডেড

Wednesday, June 7, 2017

হায়াদ্রাবাদ

দৈনিক যুগশঙ্খে প্রকাশিত দুটি ভ্রমণকাহিনী

http://jugasankhasuppli.zohosites.com/files/TRAVEL/CF%2025_24%20May%2C%202017.pdf

http://jugasankhasuppli.zohosites.com/files/TRAVEL/CF%2023_10%20May%2C%202017.pdf 

দৈনিক যুগশঙ্খ ২৪শে মে ২০১৭  







দৈনিক যুগশঙ্খ ১০ই মে ২০১৭

Saturday, February 11, 2017

বীরভূমের টেরাকোটা মন্দিরে


শীত পড়লেই মন উসখুশ! আমার রূপসী দক্ষিণবাংলায় গ্রীষ্মে তো বেড়ানোই দায়। তাই অমৃত কমলার ভোর গড়িয়ে পৌষের রোদ গায়ে মেখে প্রতিবার‌ই বেরিয়ে পড়া আর কি! কত কিছুর স্বাদ নেওয়া, কত অজানা অচেনা দ্রষ্টব্য নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে লেখা এখনো বাকী। বীরভূম এমনি একটি জেলা যেখানে দেখবার শেষ নেই। তার বোলপুর সার্কিটটা ভাল করে দেখতেই সপ্তাহখানেক সময় লেগে যাবে। আর কলকাতা থেকে গেলে শান্তিনিকেতনকে বেস করাই ভাল। সারাদিন ধরে ঘুরে এসে শান্তির বিশ্রাম নিয়ে আবারো পরদিন ঘোরা যায়। প্রচুর ট্রেন ছাড়ে কলকাতা থেকে।  আর শান্তিনিকেতন থেকে গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া যেতেই পারে। আর নিজের গাড়ি থাকলে তো কথাই নেই। 
শীত এলেই পৌষমেলার টানে কত হুজুগে  মানুষ প্রতিবছর শান্তিনিকেতনে পৌঁছে যান। কিন্তু তার সিকিভাগ মানুষজন‌ও কোলাহল মুক্ত পরিবেশে শীতকে উপভোগ করতে বোলপুর শহর ছেড়ে কিছুটা দূরে যাবার কথা ভাবতেও পারেন না। পৌষমেলা দেখে নিয়েও কিন্তু শান্তিনিকেতন থেকে অতি অনায়াসেই পৌঁছানো যায় জয়দেব প্রসিদ্ধ কেন্দুলি হয়ে ঘুরিশা আর মৌখিড়া গ্রামদুটিতে। ইলামবাজারের চৌপাহাড়ি জঙ্গল এর মধ্যে দিয়ে শীতের সকালে প্রথমে হাজির হয়েছিলাম অজয় নদের ধারে কেন্দুলি বা কেন্দুবিল্ব গ্রামে।

গীতগোবিন্দ প্রসিদ্ধ কবি জয়দেবের জন্মস্থান এই কেন্দুলি গ্রাম। মকরসংক্রান্তিতে মেলা বসে জমিয়ে। আউল-বাউল-বৈষ্ণব কীর্তনিয়া দূরদূরান্ত থেকে হাজির হন এখানে। উন্মুক্ত পরিবেশে গান-উৎসব  হয় মহা সমারোহে। জয়দেবের আরাধ্য রাধাবিনোদের টেরাকোটা মন্দিরটির পাশাপাশি কদম্বখন্ডীর ঘাটে রাধামাধবের বিগ্রহপ্রাপ্তির গল্প আজো মুখে মুখে ফেরে। অজয় নদে পুণ্যস্নান করেন অগণিত মানুষ। কবি জয়দেবের ভিটের ওপরেই রাধাবিনোদের নবরত্ন টেরাকোটা মন্দিরটি আজো নজর কাড়ে। মন্দিরের গায়ে রামরাবণের যুদ্ধ থেকে দশাবতার আর গর্ভগৃহে রাধাবিনোদের যুগলমূর্তিটি জয়দেবের আরাধ্য বলে এখনো মানুষের বিশ্বাস। বর্তমানে আর্কিওলজিকাল সোশ্যাইটির তত্ত্বাবধানে রেখাদেউল রীতিতে নির্মিত এই মন্দির । কুলেশ্বর ঘাটের কাছে কুলেশ্বর শিবমন্দিরে  কবির সিদ্ধাসন এর প্রস্তরখন্ডটি আজো রয়েছে।  প্রকান্ড এক মহীরুহ। মাটীতে টুকটুকে লাল বটফলের গালিচা আর গাছের ওপর থেকে অসংখ্য ঝুরি নামা দেখে বোঝা যায়  মূল বৃক্ষটি বট।  তার ফোকরের মধ্যে দিয়ে উঠেছে একটি পাকুড়গাছ । আর সবচেয়ে আশ্চর্য্যের ব্যাপার হল বট ও পাকুড়ের মধ্যিকারের ব্যাবধানে প্রকৃতির ইচ্ছেয় আরো দুটি বড়গাছের মধ্যস্থতায় তালের আঁটি পড়ে একটি শালপ্রাংশু তালগাছ সকলকে ছাড়িয়ে আকাশ ছুঁতে চেয়েছে। এই বট-পাকুড় আর তাল গাছের ত্রহ্যস্পর্শে বাঁধানো শানের বেদীতে গিয়ে বসলাম খানিক।  কিছুদূরেই অজয়নদের রুক্ষ ও শুষ্ক নদীবিছানা। বালির বুক চিরে একটু একটু জল। রোদের আলো পড়ে সেইটুকুই চিকচিক করে ওঠে। আদিগন্ত শুকনো চরাচর। গাছপালাও কম। জনবসতিও বিরল। অজয়নদের তীরে এই ঘাটটি নতুন করে বাঁধিয়ে সংস্কার করা হয়েছে । এরই নাম কদম্বখন্ডীর ঘাট।

এবার পা বাড়ালাম ঘুরিশার দিকে।
ইলামবাজার থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে এই গ্রাম।  শাল, সোনাঝুরির এভিনিউ এর মধ্যে দিয়ে "পায়ের মোড়" পেরিয়ে প্রথমে খোঁজ নিলাম ঘুরিশা গ্রাম পঞ্চায়েতের। কারণ হাতের মুঠোর গুগ্‌ল ম্যাপ এর দিশা অন্ততঃ তাই বলছিল।  তারপর ঘুরিশা ইস্কুল মোড় পেরুতেই চোখে পড়ল তিনোর বাসস্ট্যান্ড। স্থানীয় মানুষেরা বলল, পুরাতন মন্দির এই পথে। ব্যাস গাড়ি ঘুরিয়ে সেই পথে। স্থানীয় মানুষেরাই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ঘুরিশার বিখ্যাত রঘুনাথজী মন্দিরে।  বাংলার চারচালার স্টাইলের টেরাকোটার অপরূপ মন্দিরটি। বহু পুরণো বোঝাই যায়। সে সময় ইলামবাজার ছিল বাংলার অন্যতম বিজনেস সেন্টার। নীলকর সাহেব এবং আখচাষের হেতু চিনি উত্পাদন কেন্দ্র হিসেবে বেশ নামডাক ইলামবাজারের। ঘুড়িশা গ্রামে হত ন্যায়শাস্ত্রের চর্চা।  রঘুনাথ ভট্টাচার্য ( মতান্তরে, রঘুনাথ আচার্য ) এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আনুমানিক  সপ্তদশ খ্রিষ্টাব্দে । এটি প্রধানতঃ রামচন্দ্রের মন্দির।  মন্দিরের মধ্যে রামচন্দ্রের স্বর্ণমূর্তিটি মারাঠা বর্গীদস্যুরা লুঠ করে নিয়ে চলে যায়। তাদের  আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই মন্দির ।  এরপর স্থানীয় শ্রী রামময় পঞ্চতীর্থ ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরটিকে সংস্কার করে গর্ভগৃহে পশুপতি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।  মূল মন্দিরটি বেশ উঁচুতে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। মন্দিরের দুটি প্রবেশপথ। চার দেওয়ালের টেরাকোটার অভিনব স্থাপত্য দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।  এই পোড়ামাটির পৌরাণিক শিল্পকর্ম যে কত নান্দনিক হতে পারে আর তার বিচিত্র কারুকার্য যে কোনো ভ্রমণপিপাসু মানুষকে আকর্ষণ করবে। অনেকটা যেন বিষ্ণুপুর টেরাকোটা মন্দিরের স্টাইল সেই পোড়ামাটির কাজে। 





শীতের সকালে প্রত্যন্ত এক গ্রামের মেঠো পথ ধরে চলেছি। গ্রামের মানুষেরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে  আমাদের দিকে, ভাবে এই গ্রামের প্রাচীন মন্দিরের টানে গাড়ি চেপে শহরের মানুষ আসে ?  আর সেই মন্দিরগাত্রের টেরাকোটার মণিমুক্তো নিয়ে তাদের তো কোনো হেলদোল নেই! একজন ছেলে তার বন্ধুটিকে জিগেস করেই বসল, কি আছে রে মন্দিরে? আমি ঝটিতি জবাব দিলাম, সোনাদানা, হীরে জহরত। ছেলেটি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে র‌ইল আমার দিকে।  এ পাশে ফুলুরি-জিলিপির দোকান ওপাশে অঘ্রাণের ধান ঝাড়াই হয়ে  পৌষের রোদে সোনা হয়ে পড়ে রয়েছে। রাজহংসী কম্বুকন্ঠ ঘুরিয়ে আড়ে আড়ে চাইল অপরিচিতের দিকে। তারপরেই ধীর পায়ে নেমে গেল পুকুরের জলে। চলেছিলাম মরাই ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর সারিসারি বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে।  ধান কাটার পর্ব শেষে। এবার আসন্ন নবান্নের দিকে তাকিয়ে থাকা। এই আমার বাংলা।  বাগাল ছেলের অমলিন হাসি, গামছা গায়ে তণ্বী তনয়াদের দলে দলে পুকুর স্নান  আর হাঁস চরা থৈ থৈ পান্না পুকুরকে সঙ্গী করে এগুতে থাকি আমরা।  মাইলের পর মাইল খেতি জমিতে আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপির ফলন দেখতে দেখতে আরো এগুতে থাকি। খেজুরগাছে হাঁড়ি বাঁধা তখন। এখন এ গ্রামের ধান বুলবুলিতেও আর খায়না আর বর্গীরাও আসেনা লণ্ডভণ্ড করতে।  মন্দিরের প্রধান প্রবেশপথটি যথারীতি পুবদিকে। প্রবেশদ্বারের মাথা অর্ধচন্দ্রাকৃতি। সুচারু হাতে পোড়ামাটিতে খোদাই করা রয়েছে  ষাঁড়ের পিঠে বেশ লম্বা শিবমূর্তি। এর ঠিক ডানদিকে রাজহংসের পিঠে চতুরানন ব্রহ্মা আর বাঁদিকে গরুড়াসনা বিষ্ণু। বেশ ক্ষতিগ্রস্ত সব কারুকাজ। তবে এখনো অনেকটাই রয়েছে দেখবার মত। এছাড়াও রয়েছে ছিন্নমস্তা এবং অপরূপ এক কালীমূর্তি। কেউ মনে করেন এটি নরমুন্ডের মালা পরিহিতা চামুন্ডা কালী। এছাড়াও দশমহাবিদ্যা, দশাবতার, শিব-পার্বতী, লক্ষ্মী ও সরস্বতী মূর্তিগুলি বেশ স্পষ্ট।  কোথাও আবার টেরাকোটার প্যানেলে রাম-রাবণের যুদ্ধ, কোথাও বা বিষ্ণুর অনন্তশয্যা, রাধাকৃষ্ণের রাসলীলা চমত্কার ফুটে উঠল চোখের সামনে।  
এবার আরো এগিয়ে চলি স্থানীয় মানুষদের জিগেস করতে করতে। প্রত্যন্ত এই গ্রামে শহরায়নের ছাপ বেশ স্পষ্ট। মোবাইল ফোনের রমরমা মাটির দেওয়ালের বিজ্ঞাপনে। হাওয়ায় উড়ছে 3G, 4G কিন্তু যুবক যুবতীদের কাছে সে কনসেপ্ট এখনো অধরা। প্রকৃতি লুটেপুটে খাচ্ছে ধুলোমলিন ঘুড়িশা গ্রামের দারিদ্য। সামান্য চাষাবাদ, গরু, হাঁসমুরগী প্রতিপালন এই মানুষদের জীবিকা। তবুও হাসিমুখে উত্তর দেয় কথার। গোবর লেপতে লেপতে, ধান ঝাড়তে ঝাড়তে মেয়েরা বলে, "এই তো সামনেই, আরেকটু যান, গোপাল, লক্ষী-জনার্দন মন্দিরটা দেখতে পাবেন"
এঁকেবেঁকে ধানের গোলায় ধাক্কা খেতেই চেয়ে দেখি সুউচ্চ নবরত্ন মন্দিরের চূড়া। হিন্দুরীতি মেনে এটিও পুবমুখী মন্দির। এটিতে নিত্যপুজো হয়। আর এর অবস্থা আগেরটির চেয়ে একটু ভাল মনে হল। বহু প্রাচীন মন্দির। ১৭০০ সালের।
এ মন্দিরের সংস্কার হয়েছে দেখলেই বোঝা যায়। বসেছিলেন এক বয়স্ক মহিলা। মাসীমা বলেই তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাসিমুখে তিনি উত্তর দিলেন প্রশ্নের। বললেন, আমার শ্বশুরমশাই বর্ধমানের মানুষ ছিলেন। তিনি এর দেখভাল করতেন। নিত্য পুজোপাঠের ব্যাবস্থা তখন থেকেই দেখে আসছি। উনি থাকলে আপনারা আরো তথ্য পেতেন। মূল মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা বর্ধমানের এক গন্ধবণিক ক্ষেত্রনাথ দত্ত। ব্রিটিশ আমলে ইলামবাজারের নামকরা লাক্ষা ব্যাবসায়ী ছিলেন।  উঁচু প্ল্যাটফর্মে গিয়ে তখন আমরা একে একে টেরাকোটা প্যানেলের ছবি তুলেই চলেছি। কি অপূর্ব নান্দনিক সেই কারুকার্য। মন্দিরের তিনটি আর্চ করা প্রবেশপথ গিয়ে পড়েছে এক বারন্দায়। তারপরে মূল মন্দিরের গর্ভগৃহ।   গোপাল, লক্ষ্মী আর জনার্দণের বিগ্রহ আছে। বৃদ্ধা বললেন, জানিয়ে এলে ভোগের ব্যাবস্থা করতে পারতাম।  এই নবরত্ন মন্দিরের দেওয়ালে টেরাকোটার কাজ দেখলেই বোঝা যায় এটি বৈষ্ণব মন্দির। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, নিত্যানন্দ তাঁদের পার্শ্বদদের সাথে নৃত্যরত। এছাড়াও রাধাকৃষ্ণ ও রয়েছে। তবে আর্চ করা খিলানের মাথায়  শাক্ত ধর্মাবলম্বীর ছোঁয়া। টেরাকোটায় ফুটে উঠেছে ত্রিপুরাসুন্দরী, ষোড়শীর ন্যায় কালীর দশমহাবিদ্যার রূপ।  এছাড়াও রয়েছে রাম, সীতা, গণেশ। মঙ্গলকাব্যে বর্ণিত শ্রীমন্ত বণিকের কমলেকামিনী ও ব্রিটিশ সৈন্য নিয়ে সদলবলে যুদ্ধযাত্রা।  বৃদ্ধা জানালেন, গর্ভগৃহে প্রতিনিয়ত শালগ্রাম শিলা, গোপাল, ত্রিপুরাসুন্দরী, গণেশ এবং মঙ্গলচন্ডীর পুজোপাঠ হয়।
ডিজিটাল ক্লিকে মুখর নবরত্ন মন্দিরের টেরাকোটার দেওয়াল। নেমে দাঁড়াতেই গায়ে কষে সর্ষের তেল মাখতে মাখতে শীতের রোদ পোহাচ্ছিলেন বৃদ্ধার এক আত্মীয়। তিনি বললেন, ফেরবার সময় মনসার থানে মাথা ঠেকিয়ে যাবেন কিন্তু। সাপখোপ নিয়ে বেঁচে থাকত মানুষ সেসময়। এখন জঙ্গল কেটে সাফ। তবুও মা মনসার দোর ধরে আমরা পড়ে আছি এ গ্রামে। এগিয়ে গেলাম। মনসা মন্দিরটি আরো প্রাচীন। তার নাটমন্দিরে এক জেলে দম্পতি মাছ ধরবার জাল বুনছে । মন্দির বন্ধ। বেশ ভগ্নপ্রায় তার অবস্থা। এখন অরণ্যমেধ যজ্ঞে সামিল গ্রামের মানুষ। পালিয়েছে সাপ। আর মা মনসা তার আগেই স্বর্গবাসী  হয়ত। তবুও মানুষের বিশ্বাস যায়না ম'লে। 
এরপর আমাদের গন্তব্য ইলামবাজারের দক্ষিণে আরেকটি গ্রাম মৌখীড়ায়। বর্ধমান-বীরভূম সীমান্তে ইলামবাজার থেকে যার দূরত্ব মাত্র মাইল তিনেক।  আবার গুগ্‌লম্যাপ। আবার স্থানীয় পুছতাছ। ওদিকে পাশের দ্বারন্দা গ্রামে বনলক্ষ্মীর তপোবনে  আমাদের দুপুরের খাওয়ার ব্যাবস্থা করা আছে। অতএব ফোন ঘোরাও। ওপ্রান্ত থেকে বনলক্ষ্মীর উত্তর, দেরী হলেও আসুন । আপনাদের, গরম ভাত আর চিংড়ির মালাইকারী  রেডি থাকবে। অগত্যা চলো লেটস গো টুওয়ার্ডস মৌখীড়া। ইলামবাজারের এত কাছে মন্দিরপ্রধান গ্রাম মৌখীড়া?  সেখানেও আঠারোশো খ্রীষ্টাব্দের প্রাচীন সব মন্দির। গ্রামের রাস্তায় প্রবেশ করলেই দেখতে পাওয়া যায় ভগ্ন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।  

“It is an object very dear to my heart and I cannot help welcoming any endeavours towards its realisation”
চলেছি আর বারেবারে মনে করছি রবিঠাকুরের কথাগুলি। আমার রূপসীবাংলায় সে যুগে দলে দলে ক্রাফটসম্যান ছিলেন আর কিছু মানুষ ছিলেন এদের অকুণ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। এই সব শিল্পীদের দিয়ে তাঁরা তৈরী করেই চলতেন একের পর এক মন্দির। এ যেন কারিগরের চাঁদের হাটে বাংলার গ্রাম উঠত জেগে।  আর ছড়িয়ে পড়ত টেরাকোটার শিল্পকর্ম এভাবেই। অতএব ইট, চুন, সুরকি, বালি আর প্লাসটার। ফুটিয়ে তোলো তিরিশ কিম্বা পঞ্চাশ ফুট লম্বা মন্দিরের গায়ে সেই অভিনব পোড়ামাটির মোটিফ।  পয়সার অভাব নেই। শিল্পীর হাতের কাজ যেন শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে। তখন বাংলায় বিত্তবানদের বাস। জমিদার, রেশম  ব্যাবসায়ী, কায়স্থ, ব্রাহ্মণ, পানের বরজের মালকিন, কয়লার ব্যাবসায়ী, সকলের সম্মিলিত ধনদানে পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক বাংলার গ্রামের পর গ্রাম।  ঠিক তেমনি এক গ্রামের সন্ধান পাওয়া গেল সেদিন। নাম কালিকাপুর। সেখানকার দুর্গাবাড়ি আজো সুপ্রসিদ্ধ। নামী বাংলা ছায়াছবির শ্যুটিং স্পট। একদা নীলকুঠি পাড়া। আজো একরের পর একর তাদের জমি, প্রাসাদ, কুঠিবাড়ি সব পরিত্যক্ত, চাবি বন্ধ। আর সেই চত্ত্বরেই উন্মুক্ত প্রান্তরে জোড়া মন্দির। আবারো অভিনব স্থাপত্য তার গায়।  নীলকর সাহেবদের আধিপত্য এখনো অমলিন মন্দিরের গায়ে। প্রায় এক ফুটেরো বেশী লম্বা সারে সারে মেম সাহেবের প্রতিকৃতি মূর্ত হয়ে রয়েছে মন্দিরের গায়ে। তার সঙ্গে আমাদের সব ধর্মীয় দেবদেবীরাও রয়েছে যথারীতি। পৌরাণিক কাহিনীও বর্ণিত দেওয়াল গাত্রে।



জমিদার পরমানন্দ রায় এর পুত্র কৈলাস রায় এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। সেদিনকার মত মৌখীড়ার মন্দির দেখে এবার বনলক্ষ্মীর পথে দ্বারন্দা গ্রামে। সেখানে খেতের রাঁধুনিপাগল চাল, খেজুরের গুড়ের পিঠে, আচার, নতুন কলাই ডালের বড়ি আর হস্তশিল্প পর্ব সমাধা হতেই দেরীতে লাঞ্চ সেরেই সেদিনের মত ঘরে ফেরার গান। ভাগ্যি ভগবান কপালে প্রান্তিকে একটুকরো মাথা গোঁজার স্থান রেখেছিলেন। তাই বেলাবেলি টুক করে ঢুকে পড়েছিলাম সেখানে।  অর্থাৎ সব মিলিয়ে জমে যায় শীতের ছুটি, কেনাকাটির দুপুর, গ্যাস্ট্রনমিক ফুর্তি!  আর গ্রাম বাংলার মন্দিরময়তা আর তার সারে সারে টেরাকোটার ছবি তুলে রাখে  আমার মন ক্যামেরা। কলমে বেঁচে থাকে বাংলার ঐতিহ্য।