Sunday, August 29, 2010

"নয়নভোলানো নিউ অর্লিন্স"

২৯শে আগস্ট ২০১০,  দৈনিক স্টেটসম্যান (বাংলা) র রবিবাররের ক্রোড়পত্র বিচিত্রায় প্রকাশিত "নয়নভোলানো নিউ অর্লিন্স"

আমেরিকার অনেক নাম করা শহর যেমন নিউইয়র্ক ,ফ্লোরিডা, নিউজার্সি,  বস্টন, ক্যালিফোর্নিয়া, লস এন্জেলেস নিয়ে আমরা পত্র-পত্রিকায় অনেক গল্প, ভ্রমণকাহিনী, পড়ে থাকি । এই শহর গুলি আমাদের না ঘোরা হলেও নামগুলির সাথে আমরা অত্যন্ত পরিচিত । কেউ আমেরিকা যাচ্ছে শুনলেই আমাদের এই সব চিরাচরিত  শহর গুলির কথা প্রথমেই মাথায় আসে ।  কিন্তু আজ আমি এমন একটি শহরের নাম করব তা হয়ত অনেকের চেনা আবার অনেকের কাছেই অচেনা  । বহু পুরোনো শহর এটি । আমেরিকার একটি গুরুত্ব পূর্ণ পোর্ট আর পাঁচমিশেলি ঐতিহ্যবাহী এই শহরটির নাম নিউ-অর্লিন্স । লুইসিয়ানা স্টেটের বন্দর শহর ।  মিসিসিপি নদীর ধারে  অবস্থিত এই শহরে আমার যাবার অভিজ্ঞতা এবং সৌভাগ্য হয়েছিল ১৯৮৯ সালে । ডালাস শহর থেকে গাড়ি করে এক ভোরে আমরা পাড়ি দিয়েছিলাম নিউ-অর্লিন্সের দিকে ।   টেক্সাস স্টেট আর লুইসিয়ানা স্টেটের  মধ্যবর্তী ইন্টারস্টেট হাইওয়ে ধরে মাজদা ৬২৬ গাড়ি নিয়ে আমাদের যাত্রা হল শুরু । সাথে এক থার্মোস কফি, ইন্স্ট্যান্ট কেক মিক্স  দিয়ে বানানো কেক , কুচো নিমকি আর আইসবক্সে "কোল্ড-কার্ট" (স্যান্ডুইচ এর মাংসের স্লাইস ) , স্যান্ডুইচ ব্রেড আর কয়েকটা কোক ক্যান । ডালাস থেকে নিউঅর্লিন্স প্রায় ৮০০ কিলোমিটার । রাস্তাঘাট ভাল, পথে ছোট বড় ফুড জয়েন্টেরও অভাব নেই   কিন্তু স্টুডেন্টের পকেটমানিতে কথায় কথায় রেস্তোরাঁয় থামতে হলে নিউঅর্লিন্সে পৌঁছে মেমেন্টো কেনার সামর্থ্য হবে না তাই খাবার দাবার খানিকটা নিয়ে যাওয়া এই আর কি ।
গাড়ি করে লংড্রাইভে যেতে যেতে দেখেছি আমেরিকার রাস্তাঘাটের  বৈচিত্র্য । নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা যে বিধাতা পুরুষ ছপ্পর ফুঁড়ে দিয়েছেন এদের, দু হাত তুলে সর্বক্ষণ আশীর্বাদ করে চলেছেন আর দেশের মানুষগুলিও সর্বদা প্রাণ দিয়ে  নিজের দেশ কে আরো সজীব, আরো সুন্দর করার ব্রতে ব্রতী  ।  এত পরিচ্ছন্নতা, এত পর্রিকল্পনাময় পরিকাঠামো দেখে বারবার মনে হয়েছে ভগবানের নিজের দেশ বোধ হয় এটি । তাই বোধ হয় এত সুন্দর । তাই নিউঅর্লিন্স যাবার সময় ও বারেবারে মনে হয়েছে "তোমার গান গাওয়া শেষে রেখে যেও তব হাতের কোমল স্পর্শ , আমি আবার ফিরে এসেছি হেথায় পেরিয়ে আলোকবর্ষ"  টেক্সাসের সবুজ আর লুইসিয়ানার নীল নিয়ে চললাম । গাড়ি ছুটে চলল হাইওয়ের ওপর দিয়ে, গাড়ির অডিওতে বাজতে লাগল রাবিঠাকুরের গান "পথ দিয়ে কে যায় গো চলে " যত এগোই তত মনে হয় সবুজে-নীলে মিশে প্রকৃতি একাকার । এখানকার আকাশ বোধ হয় আরো নীল আর ধানক্ষেতের সবুজ যেন আরো বেশি সবুজ ।  গ্রাম, ভুট্টার ক্ষেত, গম ও ধানের ক্ষেত, ছোট ছোট খাল-বিল আর বক, সারস তো চললই আমাদের সাথে । ঘন্টা দুয়েক চলার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে কফি আর কেক খেয়ে আবার চলা ।হাতে একটা ম্যাপ নিয়ে পাশের ড্রাইভার ভদ্রলোকটিকে ন্যাভিগেট করতে করতে চললাম |তখন মার্চ মাস, গরম একদম নেই । বাতাসে হালকা ঠান্ডার রেশ । শেষ বসন্তের  একটুকু ছোঁয়া ।   রাস্তার ধারে বড় বড় গাছেদের পাতা ঝরে গিয়ে নতুন কচি পাতা । কোনো গাছে পাতা নেই ফুল সর্বস্ব । কত রঙ তাদের... কখনো হলুদ, কখনো বেগুনী  । বাদাম গাছের মত কোনো একটা গাছ কমলা রঙের কচি পাতাদের উদ্ধত গ্রীবা মেলে ধরেছে আকাশের সীমায়,  কখনো পেরোলাম গাছেদের সুশীতল ছায়াময় এভিনিউ ।   আমেরিকার বসন্ত বোধ করি সব জায়গায় একই রকম । আরো নীল, ঘন নীল, কচি কলাপাতা সবুজ, গাঢ় সবুজ  ।  মনে হল দোল খেললাম প্রকৃতির সাথে ।
বেলা গড়িয়ে দুপুর সূর্য যখন মাথার ওপর তখন একটা ছায়ায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে স্যান্ডুইচ বানালাম গাড়ির মধ্যে বসেই । কোক আর স্যান্ডুইচ দিয়ে সারলাম দুপুরের খাওয়া । পাশের একটা গ্যাস স্টেশনে তেল ভরে ফ্রেশ হয়ে আবার  শুরু করলাম যাওয়া । ইতিমধ্যে টেক্সাস কে ফেলে লুইসিয়ানা ঢুকে পড়েছি । প্রকৃতিগত দিক থেকে বৈচিত্র কিছু চোখে না পড়লেও ছোট,  বড় সব নদীর দেশে এসেছি মনে হল । নদীর পাড়, সেতু সবকিছুর রক্ষণাবেক্ষণ দেখে নিজের দেশের জন্য বড় মায়া হতে লাগল ।  সবশুদ্ধ প্রায় ন' ঘন্টা লাগল  নিউঅর্লিন্স পৌঁছতে । বিকেল প্রায় তিনটে তখন ।
পৌঁছলাম সাউথ-ইস্টার্ন লুইসিয়ানার অন্যতম শহর নিউ অর্লিন্সে । ভারতবর্ষে গ্রেটব্রিটেনের ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি যেমন রাজত্ব করতে এসে কোলকাতায় গড়েছিল তাদের রাজধানী ঠিক তেমনি ৭ই মে, ১৭১৮ সালে ফ্রেন্চ মিসিসিপি কোম্পানি আমেরিকায় এসে নিউঅর্লিন্স শহরের গোড়াপত্তন করেছিল । তারপর নেপোলিয়ান    এই শহরের আশপাশের এলাকা লুইসিয়ানা স্টেটকে বিক্রি করেন ১৮০৩ সালে । আমেরিকার  দক্ষিণে অবস্থিত বলে ক্রীতদাস প্রথা বহু যুগ ধরে চালু ছিল এখানে তাই জনসংখ্যার বেশিরভাগ ই কৃষ্ণাঙ্গ । তবে শহরে পা দিয়ে ই মনে হল প্রাচীন ঐতিহ্যের ছোঁয়া এখানে, পুরোণো বাড়িদের, পুরোণো ট্রামেদের সারি ,ফুটপাথ ঘেঁষা গথিক স্টাইলের স্থাপত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা স্বমহিমায় ।  কেমন একটা মন কেমন করা পুরোণো পুরোণো গন্ধ পেলাম । পরে আমেরিকার অন্য শহর গুলিতে গিয়ে যা পায়নি । ঠিক আমাদের নিউমার্কেট, এস্প্ল্যানেডের গলি আর কলেজ স্ট্রীট কফি হাউসের মাদকতার স্পর্শ অনুভব করলাম ।   তবে মেন্ট্যানেন্স আর পরিচ্ছন্নতা দেখে আবার কেঁদে উঠল প্রাণ  পুরোণো কলকাতার জন্যে ।
ডিউক অফ অর্লিন্স, ফিলিপ-ডি-অরলিন্সের  এর নামে এই শহরের নাম হয় নিউ অর্লিন্স ।    মিসিসিপি নদীর বদ্বীপে অবস্থিত এই শহরের পুব আর পশ্চিম জুড়ে শুধু তরঙ্গায়িত মিসিসিপির নীল জলরাশি আর দক্ষিণে রাজকীয় হ্রদ লেক পনচার্ট্রেন ।  অমেরিকার সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ বন্দর এটি আর অফশোর এবং অনশোর পেট্রোল এবং ন্যাচারাল গ্যাস উতপাদনে পঞ্চম বৃহত বন্দর এই নিউ অর্লিন্স ।   ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে আমাদের কোলকাতায় যেমন এক সময় ফরাসী, ওলন্দাজ সহ বহু ধর্ম ও সংস্কৃতির অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছিল নিউ অর্লিন্সে এসে ঠিক তেমন মনে হল । এই শহরটি আমেরিকার এক অনন্য শহর যেখানে নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের  মাঝে এক মাল্টিলিঙ্গুয়াল এবং ক্রস কাল্চারাল হেরিটেজের সংমিশ্রণ ঘটেছে  । আর বহুমুখী ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হয়ে নিউঅর্লিন্স বাকী আমেরিকা থেকে যেন বিছিন্ন । নতুন আমেরিকার শপিংমলের গন্ধ নেই এখানে , নেই মোড়ে মোড়ে পিত্জা জয়েন্ট বা বার্গার পয়েন্ট, নেই এক্সপ্রেস ওয়ের চাকচিক্য। বরং ইওরোপীয় সংস্কৃতির অনন্দাধারা ব‌ইছে সেখানে ।    
একটি মোটেলে গিয়ে উঠলাম আমরা । মালপত্র রেখে স্নান করে বাকি কফিটুকুর সদ্ব্যবহার করে বিকেল বিকেল বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে ।প্রথমে ই দেখলাম লাল রঙয়ের ঝকঝকে ট্রাম একখানা । ফুটপাথথেকে নেমে ট্রামস্টপেজে গিয়ে উঠে পড়লাম ট্রামে । ওখানে বলে স্ট্রীটকার ।  পাঁচমিনিটের মধ্যে ট্রাম আমাদের নিয়ে গেল নিউ অর্লিন্সের সেন্ট্রাল বিজনেস পয়েন্ট জ্যাকসন স্কোয়ারে । উইকের মাঝামাঝি ; যথারীতি ডালহৌসি স্কোয়ারের মত ব্যস্ত রাজপথ  । অফিস পাড়া বা ডাউনটাউন নিউঅর্লিন্স । সন্ধ্যে হয়ে এসেছে তখন । নিরাপত্তাহীনতার ভয় হয়ত নেই নিউইয়র্কের মত কিন্তু  পথের ক্লান্তি রয়েছে সাথে তাই সেখানে বেশিক্ষণ না থেকে ফিরে এলাম আবার ট্রামে করে । রাতে হোটেলে ফিরে ডিনার খেয়ে ঘুমোলাম । পরদিন ব্রেকফাস্ট সেরে প্রথমেই গেলাম  "vieux carre" নিউ অর্লিন্সের প্রাণ কেন্দ্র, পুরোণো নিউঅর্লিন্সের ফ্রেঞ্চকোয়ার্টার ছিল এককালে, তাই ফরাসী ঐতিহ্য বহমান এখনো রাস্তার মাঝে |এই শহরই নাকি জ্যাজ মিউজিকের পীঠস্থান বলে জনপ্রিয় । বিখ্যাত জ্যাজ শিল্পী লুই আমস্ট্রং এখানকার ই লোক জানলাম । পথে ঘাটে অণুরণিত হচ্ছে জ্যাজ টিউন ।    রাস্তার ধারে ধারে বাদ্যশিল্পীর জ্যাজ অনুশীলনবিশালকার স্যাক্সোফোন নিয়ে সঙ্গীত চর্চা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম । এ শহরের আকাশে বাতাসে জ্যাজ; আমি জ্যাজের কিছুই বুঝি না কিন্তু   নিষ্ঠাবান কৃষ্ণকায় এই মানুষ গুলির সঙ্গীতচর্চায় ডেডিকেশন দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হলাম ।
চোখে পড়ল ক্ষুদে চিত্রশিল্পীদের শিল্পকলা রাস্তার ফুটপাথে ছবি আঁকার ,রঙ, তুলি নিয়ে বিছিয়ে বসেছে । যেমন   আমাদের কলকাতা ব‌ইমেলা বসে ছবি এঁকে কত বিক্রি হয় সুন্দর সুন্দর ছবি ।  দাড়িওয়ালা এক বড় শিল্পী কিছু দূরে তার ইজেল নিয়ে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে ছবি এঁকে চলেছে । ফ্রান্সের পথে পথে এমন হয় জানতাম কিন্তু এ শহরে দেখে বড় ভাল লাগল ।ফুটপাথের ধারে প্রাসাদোপম অট্টালিকার আধুনিক বুটিকে রূপান্তকরণ যেন অধুনা অমুক নং বালিগঞ্জ প্লেস অথবা তমুক নং ল্যান্সডাউন টেরেসে নামজাদা ডিজাইনার বুটিক!  ঐতিহ্যময় বাড়ি গুলির এত সুন্দর রক্ষণাবেক্ষণ দেখে মনে হল এরা সত্যি গড়তে জানে বেশি ভাঙতে জানে কম ।  নয়নভোলানো সব আর্টগ্যালারি দেখলাম  । এ শহর যে শিল্প-গীত-বাদ্য-কলার সনতন পীঠস্থান সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই ।   মজার শহর নিউঅর্লিন্স সকলে নিজের খেয়ালখুশিতে চলে । কোনো সময়ের অভাব নেই, নেই কোনো একঘেয়েমি । কোনোবাড়ির পোর্টিকোতে গীটারে জ্যাজ বাজায় তরুণ, কোথায় আবার বিউগল বাজিয়ে ভিক্ষা চাইছে যুবক, কোথাও আবার একর্ডিয়ানে সুর তুলতে ব্যস্ত কোনো শিল্পী । মনে হল  ল্যাটিন কোয়ার্টার "Vieux Carre" আজও ফরাসীয়ানায় অমলিন।
সুন্দর বাঁধানো ফুটপাথ,  রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি, সাবেকি স্ট্রীটল্যাম্প আর টুকটুকে লাল ট্রামগাড়ি সব মিলিয়ে এ শহর বারেবারে  মনে করিয়ে দিল আমাদের তিলোত্তমার কথা.... একদা ভারতের রাজধানী পুরোণো কলকাতার কথা  । গেলাম সেন্টপিটার্স স্কোয়ারে ।  সেন্ট পিটার্স ক্যাথিড্রাল দেখলাম । বাকি আমেরিকার মত প্রোটেস্ট্যান্ট বাইবেল বেল্ট নেই এখানে । প্রধানত ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী এ শহরের মানুষ । একটা ছোট্ট বুকলেট কিনলাম শহর সম্বন্ধে জানার জন্য । এই শহর বিখ্যাত তার প্রাচীন ঐতিহ্যময়তায় । ফ্রেন্চ আর স্প্যানিশ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক বলে বিখ্যাত "mardi gras"ফেস্টিভাল এখানে হয় জানলাম ।  সেন্টপিটার্স স্কোয়ারেও নামা-অনামা কত শিল্পীর চিত্র প্রদর্শনী চলছে, যেন  ফ্রান্স শহরের পুরোনো সাবেকিয়ানা  ব‌ইছে  নিউঅর্লিন্সের কোণায় কোণায় |
গেলাম সাহেবি পাড়া ব্যস্তময় বুরবন স্ট্রীটে ।   বর্ণময় রাস্তার ধারের একটা পাবে ঢুকে এখানকার বিশেষ পানীয় "টেকিলা উইথ মার্গারিটা" খেলাম । লাঞ্চ সারলাম বুর্বন স্ট্রীটের এক পুরোণো হোটেলে ।   সেদিন প্লেটে সুসজ্জিত কেজুন রাইস আর ক্রফিস কারি নিয়ে পৌঁছে গেছিলাম পার্কস্ট্রীটের চাইনিস রেস্তোরাঁয়, এক নস্টালজিয়ায়....     লুইসিয়ানার খাবারে ক্রেওল এবং কেজুন এই দুই অভিনব ঘরানার সংমিশ্রণ ঘটেছে। স্থানীয় রেডাইন্ডিয়ানদের কুইসিন কে বলে ক্রেওল আর কেজুন হল গাল্ফ অয়েষ্টার, স্টীমড বা বয়েল্ড ক্রফিশ রেড বিনস আর স্মোকড রাইস হল এই দুই   মিশ্র খাবারের প্রধান অঙ্গ । ক্রফিশ আমাদের বাগদা চিংড়ির মত কিন্তু লবস্টার  বা কাঁকড়ার মত দাঁড়া আছে  । ট্রাইবাল কুইজিন তো কি সার্ভ করার ধরণ ধারণে সাহেবিয়ানার স্পর্শ । একটা প্লেটে স্মোকড রাইসের মাঝখানে বড় গর্ত করে ক্রফিশ কারি ঢালা রয়েছে । সে ভাবেই সকলে খাচ্ছে মাছভাত মেখে চামচ আর কাঁটা দিয়ে । সবশেষে খেলাম এখানকার অথেন্টিক সুইটডিশ "প্রালিন"| এটি এক প্রকার মিষ্টি, ক্যান্ডি জাতীয় যা তৈরী হয়  ব্রাউনসুগার, পাউডার্ড হোয়াইট সুগার, ক্রিম, মাখন আর "পেকন" বা আখরোটের মত একটি শুকনো ফল দিয়ে ।  
গেলাম নিউঅর্লিন্সের কলেজ পাড়ায় । সেন্ট চার্লস এভিনিউতে দুটি বিখ্যাত কলেজ দেখলাম । লয়োলা এবং টিউলেন ইউনিভার্সিটি । রাস্তায় একটা আর্ট এন্ড কিউরিও শপে গিয়ে কিনলাম বিখ্যাত নিউঅর্লিন্স শহরের মুখোশ , পোর্সেলিনের তৈরি এই মাস্ক । সব প্রাচীন শহরেই থাকে এমন কোনো না কোনো কিউরিও । যেমন ভুটানের ড্রাগন মাস্ক, পুরুলিয়ার ছৌ নাচের মুখোশ বাঁকুড়ার টেরাকোটার ঘোড়া আর শান্তিনিকেতনের ডোকরা ।
এবার গেলাম মিসিসিপি নদী দেখতে । ভূগোল পড়ার  সাক্ষী হয়ে চিরকাল যে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে তাকে স্বচক্ষে দেখে আত্মহারা হয়ে গেলাম । নদীর ওপর রিভার ক্রুজের ব্যবস্থা রয়েছে । খুব একটা ব্যয় বহুল ও নয় । আম-আদমী সকলেই যাচ্ছে । আমরাও চড়লাম এক মস্ত জাহাজে ।  মিসিসিপি বক্ষে ভেসেছিলাম সেদিন দুজনে.. আমার ভূগোল ব‌ইয়ের ইতিহাস সামনে দিয়ে বয়ে চলল ।
স্রোতের সুর তুলে নীলঘাগরার কুঁচি লুটিয়ে, মিসিসিপির ডেকে বসে দেখেছিলাম সূর্যাস্তের লাল রঙ ওপারের সেন্ট পিটার্স ক্যাথিড্রালও সাক্ষী হয়ে দেখেছিল সে বিকেলের সূর্যাস্তের লাল-কমলার কত খেলা!
মিসিসিপিকে বিদায় জানাতে বড় কষ্ট হয়েছিল মনে মনে বলেছিলাম "ঠিক এমন করেই থেকো তুমি যেমন আজ আছো,তোমার আকাশ আমার আকাশের চেয়েও নীল দেখে যাচ্ছি তোমার জলের রং আমার চোখের তারায় ধরে নিয়েছি তোমার আকাশে সেদিন দেখেছি পড়ন্ত সূর্য়ের লাল-কমলার খেলা
জলের ওপরে সেই ছায়া আর তার ওপরে আমাদের ছবি তা তুমিও কিন্তু রেখো ধরে সুন্দর করে.. শহর নিউঅর্লিন্সকে বলেছিলাম যদি তুমি হারিয়ে যাও একদিন যদি কোনো বিধ্বংসী ঝড় এসে তোমায় গ্রাস করে নেয় তোমার ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না, তুমি হয়ত তলিয়ে যাবে
কিন্তু আমার মনের ক্যানভাসে তুমি বেঁচে থাকবে চিরসুন্দর হয়ে"
২৯শে আগস্ট ২০০৫ এর এক বিধ্বংসি সাইক্লোন,  গাল্ফ অফ মেক্সিকো থেকে উড়ে এসে  আছড়ে পড়ে | কুখ্যাত এই সাইক্লোন  এখানে "হারিকেন ক্যাটরিনা" নামে পরিচিত। এর আঘাতে  মিসিসিপি নদীর বাঁধ ভেঙে  যায় এবং সমুদ্রের জলের উচ্ছ্বাসে সারা নিউ অর্লিন্স শহর গভীর জলে নিমগ্ন হয় । ১০০০ এরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায় অসংখ্য বাড়িঘর ভেঙে পড়ে এবং ব্যাবসা বাণিজ্যের বিপুল ক্ষতি হয় । পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব এখনো মুছে যায়নি নিউ অর্লিন্স থেকে, তার অর্থনীতি থেকে ও শহরের মানুষের মন থেকে  । "vieu carre" তে হয়ত এখনো বাজছে সেই জ্যাজ টিউনের সুর কিন্তু এ এক করুণ বিরহের সুর কারণ এখানকার দুটি ফর্চুন ৫০০ কোম্পানির মধ্যে একটির আজ কোনো অস্তিত্ব নেই |ঝড়ের ধাক্কায় কাবু হয়ে সে নিজেকে বেচে দিয়েছে দূর দেশের অন্য কোম্পানির মালিককে|
 
 

Tuesday, August 24, 2010

থান্ডার ড্রাগনের দেশে..

 ২৫ শে জুলাই ২০১০,   দৈনিক স্টেটসম্যানের রবিবারের ক্রোড়পত্র "বিচিত্রা"য় প্রকাশিত ভ্রমণ কাহিনীটি  "থান্ডার ড্রাগনের দেশে" এই নামে কভার স্টোরি রূপে 
৭ই জুন ২০১০, কোলকাতা ছেড়েছি, এসেছি প্রথমে ফ্লাইটে বাগডোগরা ও সেখান থেকে একটা গাড়ি নিয়ে আমরা চারজন মিলে রওনা দিয়েছি ভুটানের পথে । চারজন বলতে আমার স্বামী পৃথ্বীশ, ছেলে রাহুল, আমার শাশুড়ি মা আর আমি । কোলকাতা থেকে সবকিছু ব্যবস্থা করেছেন আমাদের ট্র্যাভেল এজেন্ট ইউনিকর্ন । কোলকাতার বহু প্রতিক্ষীত মৌসুমি বায়ু আর তার দোসর বর্ষা সুন্দরী অবশেষে আমাদের পিছু নিল । প্রথম বর্ষা ধুয়ে দিল ফুন্টশোলিং যাবার রাস্তা, মহানন্দার শুষ্ক কোলে তখন চরা পড়ে..দুচোখের চাহনিতে প্রখর তাপের রুক্ষতা । মনমরা মহানন্দায় বৃষ্টির আশির্বাদ ঝরে পড়ল । তারপরে বাঁদিকে তিস্তার কোল ঘেঁষে আর ডানদিকে পাহাড়কে ছুঁতে ছুঁতে গাড়ি ছুটে চলল ...কখনো তিস্তার অববাহিকায় বৃষ্টি নেই কখোনো চা বাগানের আঙিনায় গোধূলির কনে দেখা মেঘ চা পাতার ওপরে রঙ খেলছে । যাই হোক রোদ-বৃষ্টির এই লুকোচুরি খেলার সাথেসাথে পেরোলাম আমাদের ছোট নদী , বড় নদী, আরো নদী..ড্রাইভার বন্ধুটির কাছ থেকে নাম জানলাম সব চিল, মাঝালি, চেইল, মুরতি নদী রা আমাদের পথ দেখাল । বিকেলের শেষে তরাইয়ের জঙ্গলমহল পেরিয়ে ডুয়ার্সের রাজকীয় করিডোর পেরোলাম আমরা । আবার নদী! খরস্রোতা ডায়নায় তখন জল থৈ থৈ ! ঝিরিঝিরি বৃষ্টি তখন ডায়নার বুকে নাচ করে চলেছে| সুয্যি ডোবার মূহুর্তে আমরা চা খেলাম সিঙারা সহযোগে। কিছু পরেই ভুটানগেট, এ প্রান্তে ভারত ও প্রান্তে ভুটানের ফুন্টশোলিং শহর ; ফুন্টশোলিং এ রাত কাতালাম সেন্টিনিয়াল ২০০৮ হোটেলে নাতিশিতোষ্ণ জলবায়ু রাতে চিকেন হীন চাইনিজ খেলাম চিলি মাটন এর সাথে । বার্ড ফ্লু' র জন্য ভুটানের রাজার আদেশ, চিকেন ব্যান্ড সমগ্র ভুটানে !!! ভোরে উঠেই পাহাড় পাহাড ছবি, দুচোখে মেখেনিলাম, প্রথম বর্ষার গন্ধমাখা, বৃষ্টিগন্ধ পাহাড়ের গায়ে;


৮ইজুন ভোরে হোটেলে পুরী-সবজী দিয়ে ব্রেকফাস্ট ও গরম চা খেয়ে আমরা গেলাম Royal Government of Bhutan এর immigration Office.যেখানে বহিরাগতদের জন্য পরিচয়পত্র দেখে ফোটো তুলে ভুটান শহরে প্রবেশের ভিসা প্রদান করা হয় । প্রথমে আবেদন করলাম আমরা চারজনে পারমিটের জন্য ঘন্টা খানেক পরে অনুমতি পত্র হাতে পেয়ে আবার চললাম ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে । ফুরিয়ে গেল ফুন্টশোলিং !
মেঘের কোলে রোদ আর রোদের গায়ে মেঘের উড়নিকে সঙ্গে করে মেঘের মধ্যে দিয়ে আমাদের গাড়ি চলতে লাগল । পথে পড়ল ল্যান্ডস্লাইড। চড়াই-উতরাই দুর্গম এই পথ । একধারে গভীর খাদ অন্যধারে পাহাড়ের গা । এই সব বন্ধুর পথে আমাদের গাড়ির গতি কিছুটা কমে গেল। পাগলা ঝোরা দের কলকল হাসিভুলিয়ে দিল পথের বন্ধুরতা। পাহাড় গুলো যেন আরো সবুজ হতে শুরু করেছে এর মধ্যে। আর বৃষ্টির জল পেয়ে নানারকম ফুলেরা কথা বলে উঠল। আমরা পাহাড়ের ওপরে আর মেঘেরা ততক্ষণে আমাদের নীচ দিয়ে ভেসে চলেছে । পথেই পড়ল তরুণী তোর্সা । কি অপূর্ব তার রূপ লাবণ্য ! তোর্সা তবুও নবযৌবনা । ছোট্টবেলার ভূগোল ব‌ইয়ের সেই তোর্সা আমার ! আপন খেয়ালে তরঙ্গায়িত তোর্সার জলোচ্ছ্বাস নুড়িপাথরকে অবিরত চুম্বন করে চলেছে । সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে তোর্সা নেমে চলে গেল আমাদের নীচে। তখন কোনিফেরাস আর ডেসিডুয়াস বৃক্ষরাজি আমাদের অভিবাদন জানাল । মেঘের বাড়ি, মেঘের বাড়ি আর মেঘের বাড়ি পথ দেখা যায়না পথ চলা ই দায় । ইতিমধ্যে তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে । তখন ১৪ ডিগ্রি সেল্সিয়াস । পথে টেক-চেইন জ্যাম নদী আর চুখা নদী যার ওপর বিখ্যাত চুখা হাইডেল পাওয়ার প্ল্যান্ট। বুনাগায়ে চিজ মোমো দিয়ে লাঞ্চ সারলাম । আবার নদী। রাজার নামে ওয়াংচু রিভার, সাথে রোদ ঝলমলে আকাশ | বিকেল ৪টের সময় ঝকঝকে রৌদ্র করোজ্জ্বল আকাশ আর মেঘ্মুক্ত বৃষ্টিহীন বাতাস নিয়ে পৌঁছালাম থিম্পুতে । 


রাজধানী শহর থিম্পু ইস্টার্ণ হিমালয়ের কোলে সাজানো ঝকঝকে শহর, উচ্চতা প্রায় ৮০০০ ফুট । জুনের ঠান্ডা কোলকাতার ডিসেম্বরের শুরুর মত অতি মনোরম। ৯ইজুন সকালবেলায় মেঘমুক্ত আকাশকে সঙ্গে করে হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরে আবার আমরা বেরিয়ে পড়লাম থিম্পুর দর্শনীয় স্থান গুলি দেখতে । প্রথমেই গেলাম একটি মেমোরিয়ালে। ১৯৭৪ সালে যেটি বানিয়েছিলেন রাজা ওয়াংচুর মা । ওয়াংচু মাত্র ৪৫ বছরেই মারা যান তাই তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে তার মা এই বিশাল বুদ্ধ মন্দির টি বানিয়ে দেন । সেখান থেকে গেলাম টেক্স্টাইল মিউজিয়াম , ভুটান হ্যান্ডিক্রাফটস এম্পোরিয়াম । অসাধারণ ক্রাফটম্যানশিপ, নিখুঁত , দৃষ্টিনন্দন সব আর্টিফ্যাক্টস কিন্তু দাম আমাদের নাগালের বাইরে। জানিনা ইউরোপিয় টুরিস্টদের ভীড় বলে জিনিসের দাম এত বেশী কিনা । কিন্তু সাধ ও সাধ্যের নাগালে কোনো জিনিসই কেনার মত খুঁজে পেলাম না সেখান থেকে আমরা গেলাম সারবেথাং এ বোটানিকাল গার্ডেন এ । কিছুক্ষণ ফুল, আর গ্রিন হাউসে সময় কাটল । খুব সুন্দর করে সাজানো এই গার্ডেন ; আমাদের শিবপুর বোটানিকাল গার্ডেনের মত বিশালতা নেই তবে বেশ কিছু নাম না জানা ফুল দেখলাম । সেখান থেকে গেলাম পেন্টিং এন্ড স্কাল্পচার স্কুল দেখতে। কলেজের ছাত্ররা তাদের ওয়ার্কশপে বানাচ্ছে কাঠের তৈরি বিখ্যাত ভুটান মাস্ক, ড্রাগন ইত্যাদি। ধৈর্য আর নৈপুন্যের সঙ্গে বানাচ্ছে ও শিখছে তারা । কোথাও স্কাল্পচারের ক্লাস হচ্ছে । তারা মূর্তি বানাচ্ছে মোম ও ধাতু দিয়ে । হোটেলে ফিরে লাঞ্চ সেরে একটু নেট ব্রাউসিং এর সময় পেলাম যদিও খুব কম সময় তার মধ্যেই আগের দিনে লিখে রাখা আমার ট্র্যাভেলগ  আপডেট করলাম । একটু রেস্ট নিয়ে ই আবার বিকেলের হালকা রোদ কে সাথী করে গেলাম টাকিন প্রিসার্ভে। টাকিন ভুটানের জাতীয় পশু । একে গোট এন্টিলোপ বলে । শাকাহারি এই পশুটি ছাগল ও গোরুর মাঝামাঝি কিন্তু কান দুটো বিশাল আর গায়ে সোনালী লোম । ঘন পাইন বনের ওপোরে তাদের রাখা হয়েছে, উঠলাম সেখানে আর তার ছবিও নিলাম । 

তারপর গেলাম পাহাড়ের মাথায় থিম্পু ভিউপয়েন্টে একঝলকে থিম্পুর মনোরম ভিউ দেখলাম । সব শেষে একটি বুদ্ধিস্ট মনাস্ট্রিতে । পাহাড় থেকে নেমে এসে হেঁটে ঘুরলাম থিম্পু ডাউনটাউন । রাতের খাওয়া সারলাম বিখ্যাত এক সুইস বেকারীতে । এটি মিড সেভেনটিস এ তৈরি হয়। এখনো ঠাটি বজায় আছে। আমাদের কোলকাতার ফ্লুরিস এর কথা মনে করিয়ে দেয়। অতি সুস্বাদু সব স্যান্ডুইচ, প্যাটি আর কেক দিয়ে ডিনার সারলাম । রাতে হোটেলে ফিরে পরদিন যাবার তোড়জোড় শুরু হল। 

১০ই জুন স্নান ও প্রাতরাশ সেরে থিম্ফুর ফুন্টশোপেলরি হোটেলকে বিদায় জানিয়ে, পুনাখা ও ওয়াংডু শহরের পাস হাতে নিয়ে সাড়ে দশটা নাগাদ আমরা রওনা দিলাম পুনাখার পথে। এতক্ষণ একটা কথা বলতেই ভুলে গেছি, আমাদের ভারতীয় সময়ের সাথে ভুটানের ব্যাবধান আধঘন্টার । ভুটান এগিয়ে আছে এই একটা বিষয়ে । পুনাখার পথে পড়ল দোছুলা পাস, বেশ সুন্দর রমনীয় স্থান এটি। আরা পড়ল ওয়াংডি চু , বাতা চু নদী । "চু" শব্দটির অর্থ হল জল । গাড়ি ততক্ষণে নীচে নামতে শুরু করেছে । নদীর ওপরে লম্বা লম্বা গাছের থেকে ঝুলছে সার সার রঙিন ধ্বজা বা পতাকা যার ওপরে পালি স্ক্রিপ্টে লেখা তিব্বতীদের ধর্মের বাণী । আকাশে , বাতাসে মিশে যাচ্ছে সেই সব ধর্মের অমোঘ কথা, শান্তির বাণী, আদার্শতার কথা, অহিংসার কথা ; নদীর জল, বাতাস সেই বাণীর ধারক ও বাহক ...এই তাদের বিশ্বাস ! লোবেসা নামক গ্রামে পৌঁছে আমরা লাঞ্চ সারলাম থুকপা এবং চিজ মোমো দিয়ে । এবার আবার চলার পালা । কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছালাম পুনাখাতে। 

পুনাখার কাছেই ওনাখা গ্রামে পুনাটাংচু নদীর ধারে মনোময় কটেজ ; আমাদের হোটেলের নাম জাংডো পেলরি । নদীটি বিশাল লম্বা । আমাদের বারান্দায় বসে নদী দেখা যায় । পুনাখায় ঠান্ডা খুব কম । দুপুরে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে হেঁটে গেলাম নদীর ধারে। পাহাড়ের কোল আলো করে নদী অনর্গল বয়ে চলেছে নিজের খেয়ালে, গেয়ে চলেছে অবিরাম । স্বচ্ছ নদীর জলের ওপরে ছোট্ট ছোট্ট ঊর্মিমালারা কুঁচি দুলিয়ে নেচে চলেছে | সাদা বালির চর সাদা নুড়ি পাথরের সমাবেশ দেখে বুঝলাম বর্ষায় এই চর জলে থৈ থৈ করে। নদীর অতিশীতল জলে পা ডোবালাম । ভুটানে আসা পর্যন্ত চিকেনের সাথে আড়ি চলছে বলে রাহুল একটু মনমরা হয়েছিল কিন্তু নদীর জলে নামতে পেরে সে দুঃখটা ভুলে গেল ! রাতের খাওয়া সারলাম হোটেলে আজ টিপিক্যাল ভুটানিজ কুইজিন খেলাম । এসপারাগাস স্যুপ, এমা ডাটসি( লম্বা লম্বা কাঁচা লঙ্কা ও চিজ দিয়ে বানানো) , সামু ডাটসি (মাশ্রুম উইথ চিজ ) আর চাউমিন দিয়ে | পুনাখায় দিন বড় তাই সন্ধ্যে নামল রাত আটটায়। ডিনার খেয়ে এসে কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে নদীর ধারে, পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট বাড়ির সব আলো জ্বলা দেখে মনে হোল
"তোমার সবুজ অন্ধকারে জোনাক জ্বলে ঘরে ঘরে,
নদীর সুরে সুর মিলিয়ে আমি এলাম তোমার দ্বারে
পাহাড় তোমার মাদকতায়, নদীর স্রোতের উচ্ছলতায়
পেলাম তোমায় আবার আমি আপন করে নতুন করে" 

১১ইজুন ভোরে কোনো তাড়া নেই । আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে বেরুলাম ন'টা নাগাদ । প্রথমে গেলাম নেচার পার্কে স্থানীয় একটি স্কুল সেটি মেনটেন করে । পো চু এবং মো চু নদীর কনফ্লুয়েন্সে (সঙ্গম স্থল) তৈরী বিশালাকার দুর্গ যার নাম পুনাখা জঙ। এই জঙ বা Dzongএর অর্থ হল দুর্গ । পুনাখা জঙ তৈরী হয়েছিল গুরু রিংপোচি র ভবিষ্যত বাণী অনুযায়ী । গুরুর কথা অনুযায়ী এই দুর্গটি তাঁর কাল্পনিক বসত বাটি জ্যাংটোপেলরির অনুকরণে তৈরী । জ্যাংটোপেলরির অর্থ হল copper clad mountain তাই সেই কথা মাথায রেখে বানানো ; স্থাপত্য শিল্পের এক অসাধারণ এবং অভাবনীয় রূপ দেখলাম এই দুর্গে। পো চু আর মো চু নদীর দোয়াবে অবস্থিত এই দুর্গে আছে ভুটান সরকারের অফিস, গুরু রিংপোচির সমাধি আর বুদ্ধের ৩৩ ফুট লম্বা একটি মূর্তি । ভুটানের রাজার তথা সরকারের দুটি সমান্তরাল ভূমিকা আছে। একদিকে তিনি দেশের রাষ্ট্র নেতা এবং দেশ সামলান ও অন্যদিকে তিনি সমগ্র দেশের ধর্মীয় গুরু ( যদিও এখন তিনি চেষ্টা করছেন ভ্যাটিকান মডেল ছেড়ে ইংল্যান্ডের গণতান্ত্রিক মডেল দেশে আনার ) এই রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার দ্বিভাজন পরিষ্কার বোঝা গেল পুনাখা জং এ প্রবেশ করে । নদীর ওপোরে কাঠের সেতু পেরিয়ে জং এর প্রবেশ দ্বার । সেখান দিয়ে ঢুকে একধারে সারেসারে সরকারি অফিস অন্যধারে বিশাল বুদ্ধের মন্দির আর মধ্যিখানে গুরুর সমাধি ক্ষেত্র । দুর্গ তথা মন্দিরের রাজকীয় দরজা গুলি বহুধাতুর সমন্বয়ে নির্মিত এবং মন্দিরের দেযালে কাঠের ওপরে রংবেরংয়ের চিত্রকল্প অতীব দর্শনীয়।

ফিরে এসে আবার গাড়ি করে গেলাম পোচু নদীর ওপর ভুটানের সবচেয়ে দীর্ঘতম হ্যাংগিং ব্রিজ যা ৬৫০ফুট লম্বা ও মাত্র ৫ফুট চওড়া । হাওয়ায় দুলে ব্রিজের ওপর হেঁটে এ মাথা থেকে ওমাথা গেলাম । রাহুল সাথে সাথে নদীতে পাথর ফেলে ও পাথর পতনের সময় মোবাইল ফোনের স্টপওয়াচে নোট করে নিউটোনিয়ান মেকানিক্সের সূত্র (1/2 gt2)ধরে জল থেকে ব্রিজের উচ্চতা মাপল নিমেষের মধ্যে ৩১ মিটার (আন্দাজ); নদীর ধার দিয়ে হেঁটে আসার পথে ঝোপের মধ্যে একধরণের পোকাদের সমবেত ঐক্যতান শুনে তাক লেগে গেল । ফেরার পথে পুনাখার বাজারে দাঁড়িয়ে ভাদিলাল আইসক্রিম খেলাম আমরা ।
 ১২ইজুন রোদঝলমলে পুনাখার পরিষ্কার আকাশ। সকালে উঠেই দেখি আগের রাতের বৃষ্টিবাদল গেছে টুটে। আগের দিন রাতেই হোটেলের কাঠের কটেজের চালে আমি বৃষ্টির টুপটাপ শুনতে পেয়েছিলাম । যাক বৃষ্টি যে আমাদের সঙ্গের সাথী হয়নি সেই রক্ষে ; নয়ত পাহাড়ে বৃষ্টি অতি মন্দ ব্যাপার একটা । সে অভিজ্ঞতা সিকিম যাবার সময় হয়েছিল। ভুটানে আমরা চিকেন বিরহে কাতর ছিলাম । নিষিদ্ধমাংস বিফ আর পোর্ক এর প্রতি দুর্বলতা আমাদের নেই । কিন্তু প্রচুর চিজ পাওয়া যায় এখানে । তাই চিজ এর প্রেমে পড়ে গেছিলাম । সকালে চিজ অমলেট আর টোষ্ট সহযোগে ব্রেকফাস্ট সেরে আবার বেরিয়ে পড়ার পালা । এবার যাত্রা আর একটা গ্রাম ওয়াংডির দিকে। সেখানে হোটেল বুক করা আছে । মিনিট পনেরো চলার পরেই প্রথম পিটস্টপ নেওয়া হল একটি জায়গায় যেখানে আমাদের ড্রাইভার বন্ধুটি পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল।প্রায় দু কিলোমিটার হাইকিং করে পাহাড়ের মাথায় অতি জাগ্রত একটি বৌদ্ধমন্দিরে। বেশ নতুন অভিজ্ঞতা । বেশ খানিকটা ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে সরু সমতল রাস্তা ,তারপরেই চড়াই, আবার খানিকটা উতরাই এই ভাবে অনেকটা উঁচুতে উঠে মন্দির দর্শন হল। মা গাড়িতে বসে র‌ইলেন । পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে প্রচুর ধান চাষ হয় এই জায্গাটায় । আর নদীর জল আছে বলে জলের সমস্যাও নেই । রেড রাইস ভুটানের স্টেপল ফুড। তবে আমি হোটেলে খেয়ে কোনো তফাত করতে পারিনি আমাদের পরিচিত রাইসের থেকে কেবল রঙটা একটু লালচে । মন্দির দেখে এসে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে গাড়িতে ফিরে এলাম । আবার চলা শুরু । কিছুক্ষণের মধ্যেই পুনাটাংচু নদীর ধারে আমাদের ড্রাগন নেষ্ট হোটেলে এসে পৌঁছালাম। একদম নদীর ধারে হোটেল অসাধারণ নদীর ভিউ ,ঘরথেকে দেখা যায়। আর ওয়াংডি বড় বাতাসীয়া জায়গা। অতি মনোরম জলবায়ু ।
হাওয়ার গতি, মাতায় মতি,
পাহাড় ঘেরা, নদীর ঘোরা
নেইকো ঘরে ফেরার তাড়া
ফিফার সাথে চা-পকোড়া
আলসেমিতে ? নেইতো ক্ষতি !
আজ ১৩ইজুন । গতকাল রাতে ওয়াংডির ড্রাগন নেষ্ট হোটেলে ইন্টারনেট কানেক্সান পেয়ে আমরা   তিন জনেই যারপরনাই খুশী হলাম। রাতে ইন্ডিয়ান ফুড খেলাম,  গরম গরম  চাপাটির সাথে পনীর বাটার মশালা । সবশেষে ফ্রুট প্ল্যাটারে আম দেখে আমরা খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লাম । ডিনার খেয়ে ঘরে ফিরে ফিফার উন্মাদনা । সকাল হতেই স্নান খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়া । আজ গেলাম ওয়াংডির বাজারে ।বাজারে শুঁটকি মাছ বিক্রি হচ্ছে তার গন্ধে টেঁকা দায় ।   সেখান থেকে ভুটানের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফোর্ট্রেস দেখতে। রবিবার বলে মন্দির বন্ধ ছিল কিন্তু খুব প্রাচীন এই জ্ং টি পরিদর্শন করে ভাল লাগল । আজ বেশ গরম ছিল । আর বিরাট সেই নদী পুনাটাং চু পাশে বলেই খুব হিউমিড ওয়েদার পেলাম এই স্থানটির  । পাহাড় পরিবেষ্টিত নদীর ধার মনে করিয়ে দিল ১৯৮৯ এ জার্মানির রাইন নদীর কথা । তবে রাইনের ধারে প্রচুর গ্রেপ ভিনিয়ার্ডস দেখেছিলাম । এখানে  কোনো ফ্রুট অর্চার্ড দেখলাম না  । সিনিক বিউটি জার্মানির তুলনায় কোনো অংশে কম নয় সেখানে জার্মান আল্পস আর এখানে ইস্টার্ন হিমালয়ান মাউন্টেন রেঞ্জ ।  সেবার রাইনক্রুজ নিয়েছিলাম । কিন্তু এখানে কোনো রিভার ক্রুজের ব্যবস্থা নেই দেখে বিস্মিত হলাম । নদীর ধারে তৈরী হচ্ছে ওয়াংডিফোদরং শহরের নিউটাউনশিপ । নদীর ওপর তৈরী হচ্ছে হাইডেল পাওয়ার স্টেশন ।  চাষ-আবাদ, টুরিজম, পাওয়ার স্টেশনে কাজ গাড়িচালানো এই সব করেই জীবিকা নির্বাহ হয় এদেশের মানুষের । হোটেলে ফেরার পথে এক জায়গায় দুটি নদীর সঙ্গম স্থলে এক অভিনব রঙয়ের খেলা দেখলাম পো চু আর মো চু এই দুই নদীর রঙ দু রকম ; একটি  জল নীলাভ, ক্রিস্টাল ক্লিয়ার আর একটির রঙ ঘোলা । একটা নিদ্দির্ষ্ট পয়েন্টে দুজনের রঙ কে পরিষ্কার তফাত করা যায় । খুব সুন্দর ছবি নিল পৃথ্বীশ ।  
 আজ ১৩ইজুন । গতকাল রাতে ওয়াংডির ড্রাগন নেষ্ট হোটেলে ইন্টারনেট কানেক্সান পেয়ে আমরা   তিন জনেই যারপরনাই খুশী হলাম। রাতে ইন্ডিয়ান ফুড খেলাম,  গরম গরম  চাপাটির সাথে পনীর বাটার মশালা । সবশেষে ফ্রুট প্ল্যাটারে আম দেখে আমরা খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লাম । ডিনার খেয়ে ঘরে ফিরে ফিফার উন্মাদনা । সকাল হতেই স্নান খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়া । আজ গেলাম ওয়াংডির বাজারে ।বাজারে শুঁটকি মাছ বিক্রি হচ্ছে তার গন্ধে টেঁকা দায় ।   সেখান থেকে ভুটানের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফোর্ট্রেস দেখতে। রবিবার বলে মন্দির বন্ধ ছিল কিন্তু খুব প্রাচীন এই জ্ং টি পরিদর্শন করে ভাল লাগল । আজ বেশ গরম ছিল । আর বিরাট সেই নদী পুনাটাং চু পাশে বলেই খুব হিউমিড ওয়েদার পেলাম এই স্থানটির  । পাহাড় পরিবেষ্টিত নদীর ধার মনে করিয়ে দিল ১৯৮৯ এ জার্মানির রাইন নদীর কথা । তবে রাইনের ধারে প্রচুর গ্রেপ ভিনিয়ার্ডস দেখেছিলাম । এখানে  কোনো ফ্রুট অর্চার্ড দেখলাম না  । সিনিক বিউটি জার্মানির তুলনায় কোনো অংশে কম নয় সেখানে জার্মান আল্পস আর এখানে ইস্টার্ন হিমালয়ান মাউন্টেন রেঞ্জ ।  সেবার রাইনক্রুজ নিয়েছিলাম । কিন্তু এখানে কোনো রিভার ক্রুজের ব্যবস্থা নেই দেখে বিস্মিত হলাম । নদীর ধারে তৈরী হচ্ছে ওয়াংডিফোদরং শহরের নিউটাউনশিপ । নদীর ওপর তৈরী হচ্ছে হাইডেল পাওয়ার স্টেশন ।  চাষ-আবাদ, টুরিজম, পাওয়ার স্টেশনে কাজ, গাড়িচালানো এই সব করেই জীবিকা নির্বাহ হয় এদেশের মানুষের । হোটেলে ফেরার পথে এক জায়গায় দুটি নদীর সঙ্গম স্থলে এক অভিনব রঙয়ের খেলা দেখলাম পো চু আর মো চু এই দুই নদীর রঙ দু রকম ; একটি  জল নীলাভ, ক্রিস্টাল ক্লিয়ার আর একটির রঙ ঘোলা । একটা নিদ্দির্ষ্ট পয়েন্টে দুজনের রঙকে পরিষ্কার তফাত করা যায় । খুব সুন্দর ছবি নিল পৃথ্বীশ । 


বাতাসীয়া ওয়াংডুফোদরং শহরে মাঝরাতে হয় বৃষ্টি আর ভোরে মিষ্টি রোদ ওঠে। এবার মজা হল, বেলা বাড়ার সাথে সাথে শুরু হয় হাওয়ার নাচন । মেতে ওঠে ওয়াংডি শহরতলী  সেই হাওয়ায় । আর সেই সাথে মেতে ওঠে শান্ত নদীটি, পটে আঁকা ছবিটি !  হাওয়া লাগে নদীর জলে, জ্যৈষ্ঠমাসে ফাগুন হাওয়ায়  আমরা বিকেলে  হাঁটতে গেলাম পাহাড়ের ধারে। ধুলো-বালি চোখে মুখে মেখে হোটেলে ফিরলাম সন্ধ্যের আগেই । মধ্যরাতে জানলার পর্দা সরিয়ে দেখি হাওয়ার নাচন কোঁদন  সব শেষ ।

  পরদিন ১৪ইজুন  সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়েই বেরিয়ে পড়ার তাড়া কারণ ওয়াংডি থেকে সেদিন আমাদের যাত্রা ভুটানের অন্যতম শহর পারোর দিকে । সাড়ে তিনঘন্টার পথ  । যাত্রাপথের শুরুটা আমাদের চেনা কারণ ঐ পথেই আমরা এসেছিলাম পুনাখা থেকে ওয়াংডির দিকে । তার পরেই অচেনা রাস্তা শুরু হল থিম্পুর দিকে যেতে গিয়ে। পাহাড়ের এক এক রকম রং লক্ষ্য করলাম । কাছের পাহাড় গুলো হালকা সবুজ আর দূরের গুলো ঘন সবুজ কার্পেটে যেন মোড়া। এই জায়গাটায় কোনো বড় সাইপ্রাস গাছগুলো চোখে পড়ল না । উঁচু পাহাড়ের মাথায় মেঘের দলেরা যথারীতি আমাদের সাথে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল ।  পথে পড়ল সিমটোকা জ্ং । দূর থেকে প্রণাম করলাম ।থিম্ফু শহরকে পাশ কাটিয়ে কিছুটা পথ গেলাম ওয়াংচু নদীর উপত্যকা দিয়ে , ধানের ক্ষেতে, রোদের ছাওয়ায় । ভ্যালির দুপাশে শুধু সবুজ  ধান ক্ষেত , ভুট্টার ক্ষেত আর বাক-হুইট এর ক্ষেতের পাশ দিয়ে । রেড রাইসের সাথে এই বিশেষ গমটিও এদেশের মানুষের  স্টেপল ফুড, জানলাম ড্রাইভার বন্ধুর কাছ থেকে । ছোটবেলায় ভূগোল ব‌ইতে পড়েছিলাম ধান-গম চাষের উপযুক্ত জমি হল নদীর ধার  মিলে গেল । এর পরেই এল পারো চু নদী কেউ বলে পা চু । বুঝলাম পারো শহরের খুব কাছেই আমরা । 
 বিশাল নদী তবে বর্ষার জল পেলে ফুলে ফেঁপে উঠবে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না । খরস্রোতা পারো নদী বয়ে চলেছে সমতলে দূরে পাহাড়ের কোলআলো করা দিগন্তরেখা । নদীর নীলচে সবুজ জল, পাহাড়ের ঘন সবুজ আর আকাশের নীলে মিলেমিশে একাকার পারোর প্রকৃতি। পথে পড়ল সাবা আর্মি ক্যাম্প। তার পরেই রাহুল চেঁচিয়ে উঠল দুটি সমান্তরাল পাহাড়ের মাঝখানে দ্রুক এয়ারের উড়োজাহাজ কে ভাসতে দেখে । কাছ থেকে এত সুন্দর আকাশ-পাহাড়-মাটীর বুকে এরোপ্লেনের গতিময়তায় থমকে গেলাম আমরা । পাহাড়ের গা দিয়ে নামছিল সে  | দমদম-বারাসতের পথে দেখেছি এ দৃশ্য বহুবার কিন্তু সেখানে পাহাড় ক‌ই? 

এর পরেই পৌঁছে গেলাম আমাদের ট্যান্ডিলিং রেসর্টে । একরাশ বাহারী মরশুমি ফুলের মধ্যে কটেজ আমাদের । এ দেশে ফুলেদের যত্ন করতে । শুধু বীজ বা চারা লাগিয়ে দিলেই হল; আপন খেয়ালে ফুলেরা ফুটে এলিয়ে দেয় নিজেদেরকে পারোর পার্বত্য উপত্যকায় । ওয়াংডি গ্রামে হাওয়ার সাথে কথা হয়েছে, হাওয়ার সাথে পথ চলেছি, হাওয়ার সাথে  ভেসে এসেছি । পারোয় খেলছি ফুলেদের সাথে, কথা বলছি, হাসছি , আর মাখছি গায়ে ফুলের রেণু।
১৫ই জুনের ভোরে উঠে দেখি ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে । এদিকে আমাদের যাওয়ার কথা টাক্সং পাহাড়ে । ঘোড়ায় করে কিম্বা পায়ে হেঁটে পাহাড়ের মাথায় বহু পুরোণো এক মন্দির দেখতে ।  মনটা খারাপ হলেও আকাশের গায়ে পূবের সূয্যির আলো একটু একটু করে ফুটতে দেখে তাড়াতাড়ি  টোষ্ট-অমলেট-চা খেয়ে সাড়ে সাতটার সময়   রওনা দিলাম আমরা তিনজনে টাক্সং পাহাড়ের উদ্দেশ্যে  । পারো নদীর ব্রিজ পেরিয়ে রোদ ঝলমলে নীল আকাশ সঙ্গে নিয়ে পৌঁছালাম পাহাড়ের নীচে গাড়ী করে ।  প্রচুর টুরিস্টের আগমনে ঘোড়া পাওয়া গেলনা  । অগত্যা পা'যুগলই ভরসা আমাদের । লাঠি সাথে নিলাম। আপেল অর্চার্ড পেরিয়ে পাগলা ঝোরাদের কলকল হাসি আর অজানা পাখিদের কূজনকে সঙ্গে নিয়ে খাড়াই পাহাড়ে চড়া শুরু হল । এক ধারে পাহাড় অন্যধারে সাইপ্রাসের ঘন জঙ্গল , নীচে তাকানো যায়না এত গভীর।  কিছুটা ওঠার পরেই শ্বাস কষ্ট শুরু হল আমার । তবুও আমি হাল ছাড়ার পাত্রী নই ।


তাপমাত্রাও কমতে লেগেছে ইতিমধ্যে । কিন্তু  রোদের তাপ বাড়তে শুরু করায় গায়ে গরম জামাকাপড় খুলতে শুরু করলাম আমরা । হঠাত চোখে পড়ল ঘন অরণ্য আলো করে দূর থেকে হাতছনি দিচ্ছে আমার অতিপ্রিয় রডোডেনড্রণ পুষ্প গুচ্ছ।  কোথাও টুকটুকে লাল কোথাও গাঢ় গোলাপী, কোথাও হালকা বেবি পিঙ্ক কোথাও বা হলুদ রঙের । শুনেছি ১৩ রকমের ভ্যারাইটি আছে এই ফুলের । বসন্তে আসিনি তাই ভেবেছিলাম এর দেখা পাবনা । 

 রডোডেনড্রণের  অপ্রত্যাশিত দর্শনে  আপ্লুত হয়ে আমি উঠতে শুরু করলাম অবলীলাক্রমে। প্রায় ৩কিলোমিটার চড়াই অতিক্রম করে পৌঁছালাম পাহাড়ের মাথায় ভিউ পয়েন্টে সেখানে টাক্সং কাফেতে কফি খেয়ে বিশ্রাম নিলাম । তার চেয়ে আর ও ওপরে মন্দিরে চড়ার মত অবস্থা ছিলনা আমার যদিও রাহুল আর পৃথ্বীশ খুব উতসাহী ছিল কিন্তু আমার জন্য বেচারীদেরও যাওয়া হল না ।  তখন সময় সাড়ে দশটা । এবার নীচে নামার পালা । তখন আর শ্বাস কষ্ট নয়, পায়ের পেশীতে টান পড়ছিল । যাক প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে উতরাই পথে নেমে এলাম নীচে।  গাড়িতে ফিরে এসে আবার হোটেল । গরম ভাত-মুসুরডাল-ফ্রেঞ্চফ্রাই সহযোগে লাঞ্চ সেরে সোজা এসে শয্যা নিলাম আমি ।   

 ১৬ই জুন একটু দেরী করে ঘুম ভাঙল । আগের দিনের হাইকিংয়ের ফলে শরীরের ট্রমা ভাব ঘুমিয়ে কেটে গেছে তাই রক্ষে । অবশ্য আমি বেশী হাঁটাহাঁটি হলেই প্যারাসিটামল খেয়েনি  সেফ গার্ড হিসেবে যাতে পরের দিন ব্যথা না বাড়ে। আজ কোনো তাড়া নেই । স্নান-প্রাতরাশ সেরে নটায় বেরিয়ে পড়লাম । প্রথমেই পারো নদীর ব্রিজের ওপর গিয়ে শান্ত-স্নিগ্ধ নদীটির  ছবি নিলাম কারণ আগের দিন মেঘ ছিল আকাশে । নদীর জলে মেঘের ছায়া পড়লে নদীর ছবি ভাল হয়না  । আজ পারোয় আমাদের শেষ দিন ও রাত তাই বুঝি পারো সুন্দরী মেঘমালাদের মানা করে দিয়েছিল তার ত্রিসীমানায় আসতে। নদীতীরকে শেষবারের মত দেখে নিয়ে গেলাম কিচু মন্দিরে । সপ্তদশ শতাব্দীর এই মন্দিরটি ইন্ডিয়ান সাধু পদ্মসম্ভবের (যিনি ভুটানের গুরু রিংপোচি নামে খ্যাত)   স্মারক হিসেবে  নির্মিত। মন্দিরটি অতি প্রাচীন, তা দেখলেই বোঝা যায় | মন্দির চত্বরে কমলালেবু গাছে ভর্তি লেবু ধরে আছে ।  মন্দিরের ভিতরে গুরুর প্রায় ৩০ফুট লম্বা ধাতব মূর্তি । মন্দিরের বাগানে বহু পুরোণো ফলন্ত একটি ওক গাছ এবং প্রচুর আপেল গাছ । সব মিলিয়ে মন্দিরটির অন্দরে ও বাইরে কিছু মাহাত্ম্য অনুভব করলাম । এরপর গেলাম পারোনদীর অপর পারে অবস্থিত তা জ্ং পরিদর্শন করতে ; তা জংটি একটি অতি প্রাচীন  এবং অভূতপূর্ব একটি ফোর্ট্রেস যেটি একটি চোঙাকৃতি আটতলা কাঠ ও পাথর দিয়ে তৈরী বাড়ি । ১৭১৪ সালে ভুটানের ১৫দিন ব্যাপী ভয়ংকর ভূমিকম্পেও তার গায়ে আঁচ পড়েনি  । এই তা জ্ংটি বর্তমানে  ন্যাশানাল মিউজিয়াম অফ ভুটান  হিসেবে  ব্যবহৃত হচ্ছে । 
 এখানে ভুটানের ঐতিহ্য থেকে শুরু করে  বুদ্ধের অসাধারণ সব মূর্তি , মহাকালীর মূর্তি,  যমরাজের বিশালাকার একটি মুখোশ, প্রাচীনতংখা, ফ্রেস্কো, বাসন পত্র, পূজার সামগ্রী, ভুটানের পুরুষের পোশাক "ঘো" আর মহিলাদের পোশাক " কিরা", রূপোর অলঙ্কার সুন্দর ভাবে রক্ষিত । গোলকধাঁধার মত এই  মিউজিয়াম । ঘুরতে খুব ভাল লাগল ।  জ্ংএর ৬তলায় রাখা রয়েছে  চারটি ধর্মীয় ধারার গুরুদের মূর্তি ; একটি স্থাপত্যকীর্তির মাধ্যমে  সেটিকে দেখানো হয়েছে, যেটিকে বলে  Tshogzing  ।    মিউজিয়ামের ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ।  মিউজিয়ামের রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচ্ছন্নতা প্রশংসার দাবী রাখে।
মিউজিয়াম দেখে মন ভরে গেল আমাদের । সেখান থেকে আমরা গেলাম পারো জং পরিদর্শন করতে। কিন্তু আমাদের ড্রাইভার বন্ধুটি হঠাত খেয়াল করল পাহাড়ের নীচে সমতলে আর্চারী ট্যুর্নামেন্ট হচ্ছে। ধনুর্বিদ্যা এখানকার জাতীয় স্পোর্টস । রাহুল আর সেখান থেকে নড়তে চাইল না । অগত্যা গাড়ি ঘুরিয়ে সেখানেই যাওয়া হবে স্থির হল ।  বিরাট একটা ইভেন্ট হচ্ছে। এদেশের কলির কর্ণ-অর্জুনেরা হাইটেক ধনুক নিয়ে তীর  ছুঁড়ে লক্ষ্যভেদ করছে । এই ধনুক অর্জুনের গান্ডীব নয় বা রামের হরধনু নয়, সফিস্টিকেটেড ধনুক যাতে আমাদের দেশের দোলা ব্যানার্জিও সাবলীল  । একজন ধনুর্ধর লক্ষ্যভেদে সফল হলে সমগ্র টিম তাকে অভিবাদন জানাল জংখায় গান ধরে আর সাথে আমাদের মাদলের মত সম্মিলিতভাবে তালে তালে নেচে   । আমাদের নতুন অভিজ্ঞতা হল। 

 সেখানে এক স্থানীয় মহিলার কাছ থেকে গার্ডেন ফ্রেস পিচ ফল কিনলাম । মহিলার ছবি নিলাম । সে বেজায় খুশি হয়ে আমাকে আরো ক'টি পিচ ফল উপহার দিল । এবার পারোর বাজারের দিকে গেলাম। মা অনেকদিন ধরে আম কেনবার জন্য ব্যস্ত হয়েছিলেন । তাই বাজারে ঢুকে প্রথমে বেজায় দামে ল্যাংড়া আম কেনা হল । তারপরে বেকারী শপে এসে কেক কেনা হল । টুকটাক কেনাকাটির পরে আমরা গেলাম একটি হ্যান্ডিক্রাফ্ট শপে । সেখানে ইয়াকের হাড় দিয়ে তৈরী একটি বুদ্ধ মূর্তি কিনে ফেললাম। এবার লাঞ্চ খাবার পালা । খুব সুন্দর রেস্তোঁরায় স্যুপ, চাউমিন আর চিলি চিকেন দিয়ে লাঞ্চ সেরে হোটেলে ফেরা হল । এবার বিশ্রাম নিয়ে গুছোনোর পালা ; পরদিন ভোরেই রওনা হলাম ফুন্টশোলিংয়ের পথে, দেশের দিকে, আমাদের জার্নির শেস ধাপ ডুয়ার্সের পথে হাসিমারার কাছে চিলাপাতা রেসর্টে ।